হুমকির মুখে বন্য প্রাণ – বিধান চন্দ্র দাস
বিশ্বব্যাপী হুমকির মুখে বন্য প্রাণ বা ‘ওয়াইল্ডলাইফ’। অনেকে ‘ওয়াইল্ডলাইফ’-এর বাংলা ‘বন্য প্রাণী’ করলেও পৃথিবীর বেশির ভাগ ইংরেজি অভিধানে ‘ওয়াইল্ডলাইফ’ বলতে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো প্রাণী ও উদ্ভিদ তথা জীবনকে বোঝানো হয়েছে। সেই কারণে আমি ‘ওয়াইল্ডলাইফ’-এর বাংলা ‘বন্য প্রাণ’ সংগত বলেই মনে করি। বলা হচ্ছে যে পৃথিবীর জল ও স্থলে বসবাসকারী অসংখ্য বন্য প্রাণের জীবন আজ হুমকির মুখে। জাতিসংঘের সিবিডি (কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি) সচিবালয় থেকে জানানো হয়েছে যে পৃথিবী থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০০ থেকে ১৫০টি জীবপ্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে। আইইউসিএনের জরিপে (২০১৭) প্রাণবৈচিত্র্যের ২৯ শতাংশ প্রজাতি হুমকিগ্রস্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কয়েক বছর আগে (২০১২) নেচারে প্রকাশিত এক খবরে প্রতি পাঁচটি অমেরুদণ্ডীর মধ্যে একটি বিলুপ্ত হওয়ার হুমকিতে আছে বলে বলা হয়েছিল। জীববৈচিত্র্যের ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির সতর্কবার্তা নব্বইয়ের দশকেই শোনা গিয়েছিল। এসব সংবাদ আর পরিসংখ্যান বিশ্বব্যাপী বন্য প্রাণের অস্তিত্ব সংকটের ভয়াবহ চিত্র মেলে ধরে। আর এ জন্যই বন্য প্রাণকে রক্ষার জন্য পৃথিবীব্যাপী নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের ৬৮তম (২০ ডিসেম্বর ২০১৩) অধিবেশনে বিপন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদ (বন্য) রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মার্চ মাসের ৩ তারিখকে ‘বিশ্ব বন্য প্রাণ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই তারিখটি বেছে নেওয়ার কারণ হচ্ছে, ১৯৭৩ সালের ৩ মার্চ ওয়াশিংটনে ৮০টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বিপন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদ রক্ষায় বহুপক্ষীয় একটি চুক্তি (সিআইটিইএস—কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেঞ্জারড স্পিসিস অব ওয়াইল্ড ফনা অ্যান্ড ফ্লোরা) চূড়ান্ত করা হয়। বর্তমানে এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা ১৮৩। এবারের বিশ্ব বন্য প্রাণ দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে, ‘বাঘজাতীয় প্রাণী : হুমকির মুখে শিকারি প্রাণিদল’।
সিআইটিইএসের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে সারা পৃথিবীতে বাঘ, সিংহ ও চিতাবাঘের মোট সংখ্যা ৩০ হাজারের মতো। অথচ ১০০ বছর আগে পৃথিবীতে বাঘ ও সিংহের সংখ্যাই ছিল তিন লাখেরও বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত দু-তিন দশকে অনেক বেশি বন্য প্রাণ কমেছে। আবাসস্থল ধ্বংস, মানুষের সঙ্গে সংঘর্ষ, চোরা শিকার এবং এদের নিয়ে অবৈধ ব্যবসার কারণেই এদের সংখ্যা কমে এসেছে। বাঘ, চিতাবাঘ, সিংহ, বনবিড়ালের মতো প্রাণীগুলো অন্যান্য প্রাণী শিকার করেই জীবন ধারণ করে। বাসস্থান সংকট, চোরা শিকার কিংবা অন্য কোনো কারণে শিকারের সংখ্যা কমে গেলে সেটিও শিকারি প্রাণীদের ওপর প্রভাব ফেলে। আইইউসিএনের ওয়েবসাইটে বিশ্বব্যাপী বাঘজাতীয় প্রাণী কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে চোরা শিকার এবং অবৈধ হত্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
একসময় বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় সব বনজঙ্গলে বাঘ পাওয়া যেত। গত শতকের ত্রিশের দশক পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের তদানীন্তন ১৭টি জেলার মধ্যে ১১টি জেলায় বাঘ ছিল বলে জানা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিজমি বের করা এবং জনবসতি গড়ে ওঠায় বাঘের আবাসস্থল ও খাদ্য সংকট দেখা দেয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষের সঙ্গে সংঘর্ষজনিত কারণেও বাঘের মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়। একসময় বাঘ শিকারকে কৃতিত্ব হিসেবে দেখা হতো এবং বাঘ মারতে পারলে আর্থিক পুরস্কারেরও ব্যবস্থা ছিল। এসব কারণে বাঘের সংখ্যা কমে যেতে থাকে এবং সুন্দরবন বাদে অন্যান্য এলাকার বনজঙ্গল থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কালেভদ্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকার বনে দু-একটি বাঘ দেখা যায়।
সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। আইইউসিএন আমাদের সুন্দরবনে ১০৬ থেকে ৫০০টি বাঘ আছে বলে তাদের ২০১৫ সালের প্রকাশনায় উল্লেখ করে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জার্নালে ২০১৩ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বাংলাদেশ সুন্দরবনে বাঘের জন্য মোট ২৩টি হুমকির কথা বলা হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে মোট আট প্রকার বাঘজাতীয় বন্য প্রাণী প্রজাতি রয়েছে। এরা প্রত্যেকেই কমবেশি অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে আছে। আইইউসিএনের প্রকাশনায় বাঘ, গেছোবাঘ ও চিতাবাঘকে মহাবিপন্ন; মেছোবাঘকে বিপন্ন; সোনালি বিড়াল, বনবিড়াল ও চিতাবিড়ালকে সংকটাপন্ন প্রাণী প্রজাতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। গেছোবাঘ ও চিতাবাঘকে দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের মিশ্র চিরহরিৎ বনে কদাচিৎ দেখা যায়। এ এলাকায় সোনালি বিড়ালকেও মাঝেমধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। বনবিড়াল ও চিতাবিড়াল বনে এবং গ্রাম্য ঝোপঝাড়ে এখনো কোনো কোনো সময় দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে অন্যান্য বন্য প্রাণও খুব ভালো অবস্থানে নেই। আইইউসিএন বাংলাদেশ থেকে ৩১টি প্রাণী বিলুপ্ত হওয়াসহ মোট ৩৯০টি প্রাণী প্রজাতি হুমকিগ্রস্ত বলে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা অনেক বেশি। বিশেষ করে অমেরুদণ্ডী প্রাণী, যারা প্রাণবৈচিত্র্যের প্রায় ৮০ শতাংশ অধিকার করে আছে, তাদের অতি ক্ষুদ্রাংশের মূল্যায়ন করা হয়েছে।
সত্যি কথা বলতে—বাংলাদেশের বন্য প্রাণ (ওয়াইল্ড লাইফ) কিংবা বন্য প্রাণীর (ওয়াইল্ড এনিম্যাল) সামগ্রিক চিত্র আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। দেশে বন্য প্রাণের বা বন্য প্রাণীর প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে আমাদের ধারণা অস্পষ্ট। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে বন্য প্রাণী, এমনকি বন্য প্রাণ বলতে সাধারণত মেরুদণ্ডীদের বোঝানো হয়। আমাদের যত আগ্রহ আর আকর্ষণ হচ্ছে, মেরুদণ্ডী প্রাণী অর্থাৎ বাঘ, হরিণ, পাখি, কুমির, ডলফিন, ব্যাঙ, মাছসহ বড় সব প্রাণী, যাদের অবস্থান পৃথিবীর সমগ্র জীববৈচিত্র্যের ৪ শতাংশেরও নিচে।
বাঘজাতীয় প্রাণীদের রক্ষায় তাদের আবাসস্থল রক্ষা, চোরা শিকার ও তাদের হত্যা বন্ধ করা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু বাঘদের সেই আবাসস্থল রক্ষার জন্য সেখানে বসবাসকারী অমেরুদণ্ডীসহ যাবতীয় প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তাকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। সুন্দরবনে সুন্দরী, গরান, বাইন, কেওড়া প্রভৃতি গাছ না থাকলে ম্যানগ্রোভ বন থাকবে না। আর এই গাছগুলোর বেঁচে থাকা ও বংশবৃদ্ধির জন্য সেখানকার কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক থেকে শুরু করে মৌমাছিসহ অন্য অনেক অমেরুদণ্ডীর বেঁচে থাকা প্রয়োজন। কাজেই বাঘজাতীয় প্রাণী তথা বন্য প্রাণ রক্ষায় আমাদের সামগ্রিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়