১৫ আগস্ট : প্রথম প্রভাতফেরি
আনিস আহামেদঃ বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বোস অধ্যাপক ড. আবদুল মতিন চৌধুরী। মুজিব-প্রেমিকদের দুঃসময়ে উনি লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে এলেন ১৯৭৮ সালে। জহুরুল হক হল মিলনায়তনে ছাত্রলীগ তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। ছাত্রলীগের প্রধান ঘাঁটিতে ছাত্র সংসদের ভিপি মোহন ভাই, জিএস মুনির ভাই। ক্যাফেটরিয়ায় বিকেলে বসতেন ছাত্রলীগ সভাপতি ওবায়দুল কাদের, জালাল ভাই, হারুন (যুবলীগ) ভাইয়েরা।
১৯৭৮ থেকে দীর্ঘ কয়েক বছর জাতীয় শোক দিবসের মূল আলোচনা সভা বঙ্গবন্ধু পরিষদ আয়োজন করত টিএসসি মিলনায়তনে। ড. নীলিমা ইব্রাহিম, আবুজাফর শামসুদ্দিন, বিচারপতি কেএম সোবহান, বিচারপতি মোহাম্মদ হোসেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহমদ হোসেন, বিশ্ব শান্তি পরিষদের আলী আকসাদ, খন্দকার মো. ইলিয়াস, অধ্যাপক কবির চৌধুরী, সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত, অ্যাডভোকেট গাজীউল হকÑ এদের সারগর্ভ আলোচনার কথা এখনও মনে আছে। সবার ওপরে মতিন স্যার। উদীচী পরিবেশন করত মুক্তিযুদ্ধের গান, গণসংগীত, গীতিনাট্য ‘ইতিহাস কথা কও’। কবিতা পাঠ করতেন নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, খালেদা এদিব চৌধুরী প্রমুখ প্রতিবাদী কবিবৃন্দ।
ড. মতিন চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর তার ভাষণ ‘সংকলন বাংলাদেশের সমাজ বিপ্লবে বঙ্গবন্ধুর দর্শন’। ১৯৮০ সালে বঙ্গবন্ধু পরিষদ সিদ্ধান্ত নিল, ১৫ আগস্ট প্রভাতফেরি বের করা হবে। প্রভাতফেরির সূচনাস্থল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
তখন রমজান মাস ছিল এবং ভোর থেকে একাধারে মুষলধারে বৃষ্টি, ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ বাবু (নিখোঁজ) নেতৃত্বে ঢাকার ছাত্রলীগ কর্মীরা শহীদ মিনারে সমবেত হলাম কাকভেজা হয়ে। লালবাগের জাফর ইকবাল বাবু, আসলাম সানী, বিএম মোজাম্মেল হক, আবদুস সাত্তার মাসুদ, শাহ আলম মুরাদ, গোলাম রব্বানী বাবলু প্রমুখ। সূত্রাপুরের কেএম শহিদুল্লাহ, নূর হোসেন, জাজাউর রহমান আলো-সহ আরও অনেকে। জগন্নাথ কলেজের জাকারিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে ছাত্রলীগ কর্মীরা, ঢাকা কলেজের ভিপি কামরুল আহসানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ, হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গের অনুগামী নগরের বিভিন্ন প্রান্তের ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা-কর্মীরা।
সকাল ১০টায় প্রভাতফেরি শুরু হলো ব্যানার ও হাতে লেখা ফেস্টুন নিয়ে, উদীচীর সাথে প্রভাতফেরিতে আমরা সুর ধরলাম, রবীন্দ্রসংগীত ‘মরণ সাগর পাড়ে, তোমরা অমর তোমাদের স্মরি; সংসারে জ্বেলে গেলে যে নব আলোক জয় হোক, জয় হোক, তারই জয় হোক।’ প্রত্যেকের হাতে এই শোকসংগীতের লিফলেট দেওয়া হয়েছিল।
অঝোর বৃষ্টিতে শোকার্ত রাজপথ ধরে পলাশী, আজিমপুর, নিউমার্কেট, কলাবাগান হয়ে প্রভাতফেরি পৌঁছাল বঙ্গবন্ধু ভবনের বন্ধ দুয়ারের সামনে। আসলাম সানী ছাপানো কালো ব্যাজ প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে অর্পিত হলো শ্রদ্ধাঞ্জলি। ১৯৭৫-এর পর এই প্রথম ১৫ আগস্টে আমাদের বঙ্গবন্ধু ভবনের ফটকের সামনে সমবেত হওয়ার সুযোগ দিল খুনিদের দোসর রাষ্ট্রপতি জিয়ার অনুগত প্রশাসন।
ওই দিন বিকেলে খুনিদের প্রতিরোধ করতে গোপন সিদ্ধান্ত নিল ঢাকার যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা। ঢাকা মহানগর ক্রীড়া সমিতি মিলনায়তনে খন্দকার মুশতাক, অলি আহাদ, মোহসেন উদ্দিন দুদুমিয়া, আজিজুল হক নান্না মিয়া, এসএম সোলায়মান, শাহ্ মোয়াজ্জেম গংরা ১৫ আগস্ট নাজাত দিবস পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এই কর্মসূচি বানচাল করতে আওরঙ্গ ভাইয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী ওই দিন বিকেলে দর্শক সেজে সমাবেশস্থলে সমবেত হয় মাহফুজ বাবু, আসলাম সানী, ইউনুস সূমন, জামালউদ্দিন ইউসুফসহ ২৫-৩০ সাহসী মুজিব সৈনিক। এই কর্মসূচি পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর হতে পারেনি আবদুর রাজ্জাক ভাইয়ের অনুসারীদের কারণে। মতিউর রহমান রেন্টু, সালাউদ্দিন বাদলের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জনের প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে গুলিস্তান কামানের সামনে দিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ বাধা দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ফলে সভাস্থলে পুলিশ এবং খুনিদের ক্যাডাররা কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি করে। অস্ত্র নিয়ে সেখানে প্রবেশ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। অলি আহাদের বক্তব্যের সময় ধর শালাদের চিৎকার করে মাহাফুজ বাবু চেয়ার ছুড়ে মারে মূল মঞ্চে। হৈ-হট্টগোল শুরু হয়ে যায়, মুশতাকের ক্যাডারদের আঘাতে জ্ঞান হারিয়ে ধরাশায়ী হন মাহাফুজ বাবু এবং ঘটনাস্থল থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কয়েক মাস কারাভোগ করে মাহাফুজ বাবু জামিনে বেরিয়ে আসেন। আমরা তাকে নিয়ে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান করলাম, আজিমপুর শেখ সাহেব বাজারের আমতলাস্থ লালবাগ থানা ছাত্রলীগ অফিসে।
সেদিন বিকেলে কলাবাগান মাঠে বড়সড় কাঙালি ভোজ অনুষ্ঠিত হলো। এই আয়োজনের প্রধান ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ ও ফজলুল করিম। আমরা যারা সারাদিন রোজা রেখে দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছি, তারা কাঙালি ভোজের খিচুড়ি দিয়ে ইফতার করলাম।
১৯৭৮, ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে লালবাগ থানা ছাত্রলীগ প্রকাশ করল ১৫ আগস্টের স্মরণিকা ‘মুজিব কণ্ঠ’। ট্যাবলয়েড সাইজে নিউজপ্রিন্টে। ১৯৮১ সালের ১৫ আগস্ট প্রকাশিত হলো বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা ও ছড়া স্মরণিকা বই আকারে চার রঙা প্রচ্ছদ, ভেতরে হোয়াইট প্রিন্ট। সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলেন জাফর ইকবাল বাবু, আসলাম সানী, ইউসূফ হাসান। এই সংকলনে সর্বকনিষ্ঠ লেখক ছিলাম আমি। বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত আমার ছোট কবিতা ‘আসবে নতুন যিশু’। কবিতাটি হলোÑ
বসন্তের আহ্বানে জন্মেছিল একটি শিশু
যেমন মা মেরির কোলে
শান্তির দূত নতুন যিশু।
যিশুর মতোই স্বভাব তার
দুঃখ দেখে কাঁদতো মন
শোষিতদের আশেপাশে
জেগে থাকতো সারাক্ষণ।
চির সত্য ন্যায়ের পথে
সব লোকেরে ডাকতো সে
পাপ ভরা কলুষ মনে পুণ্য চিহ্ন আঁকতে যে
পাপীদের হাতে যিশুর মতোই
হারিয়ে গেল নতুন যিশু
আবার কবে আসবে ফিরে
যিশুরূপী নতুন শিশু?