১৯৪৯ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধু
১৯৪৯ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণী কর্মচারীদের বেতন, সুবিধাদি ও দাবি-দাওয়া নিয়ে অসন্তোষ ও আন্দোলন চলছিল, তখন শেখ মুজিবুর রহমান আইন বিভাগে ২য় বর্ষের ছাত্র।
সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণী কর্মচারীদের বেতন ছিল ১১ থেকে ১৪ টাকা। চাকরির শুরুতে কর্মচারীদের অধিকাংশই কোন নিয়োগপত্র পেত না। চাকরিতে স্থায়ী হতে তাদের নানা ভোগান্তি তো ছিলই, ছিল অকারণে চাকরিচ্যুতির হুমকি। কর্মচারীদের জন্য থাকার কোনো স্থায়ী/অস্থায়ী বাসস্থান কিংবা আবাসিক ব্যবস্থা ছিল না।
কর্মচারীরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে দীর্ঘদিন দেন- দরবার চালিয়ে আসা সত্ত্বেও তাদের প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায়, ন্যায্যতা আদায়ের জন্য ১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ থেকে থেকে কর্মচারীরা ধর্মঘটে চলে যান। কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজও সহায়ক শক্তি হিসেবে এগিয়ে আসে।
৩ মার্চ সংগ্রামী ছাত্র সমাজ ক্লাস বর্জন করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে ৫ মার্চ পূর্ণ ছাত্র ধর্মঘটের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অপরাহ্নে অনুষ্ঠিত হয় একটি ছাত্রসভা। এই সভায় ছাত্ররা স্থির করে যে কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া যতক্ষণ না আদায় হবে, কর্তৃপক্ষ যতদিন না স্বীকার করবেন তাদের দুর্দশার প্রতিকার, ততদিন পর্যন্ত তারা সহানুভূতি সূচক ধর্মঘট অব্যাহত রাখবে।
শেখ মুজিব তরুন নেতা হিসেবে এই আন্দোলনকে শুধু সমর্থনই করেননি, তিনি এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
ছাত্রদের সংশ্লিষ্টতায় কর্মচারীদের আন্দোলন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্য চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের নির্দেশানুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই আন্দোলন মোকাবিলা করতে গিয়ে নেতিবাচক পন্থায় দমন করার উদ্দেশ্যে ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলনে যুক্ত থাকা ২৭ জন ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করায় ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়। ৪ বছরের জন্য বহিষ্কার হয় ৬ জন, হল থেকে বহিষ্কার ১৫ জন, ১৫ টাকা জরিমানা ৫ জন এবং ১০ টাকা জরিমানা ১ জন। ছাত্রলীগের আহবায়ক নইমুদ্দিনের ১৫ টাকা জরিমানা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ টাকা ও লুলু বিলকিস বানুর ১০ টাকা জরিমানা করা হয়।
১৯৪৯ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করায় শাস্তিপ্রাপ্ত ২৭ জনের নাম ও শাস্তির মাত্রাঃ
৪ বছরের জন্য বহিষ্কারঃ ৬ জন
১। দবিরুল ইসলাম (আইনের ছাত্র), ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ
২। আবদুল হামিদ চৌধুরী (বি কম দ্বিতীয় বর্ষ)
৩। অলি আহাদ (বি কম দ্বিতীয় বর্ষ)
৪। আবদুল মান্নান (বি এ ক্লাস)
৫। উমাপতি মিত্র (এম এস সি পরিক্ষার্থী)
৬। সমীর কুমার বসু (এম এ ক্লাস)
হল থেকে বহিষ্কারঃ ১৫ জন
১। আব্দুর রহমান চৌধুরী (আইন ছাত্র), সহ সভাপতি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদ
২। মোল্লা জালালউদ্দিন (এম এ ক্লাস)
৩। দেওয়ান মাহবুব আলী (আইনের ছাত্র)
৪। আবদুল মতিন (এম এ ক্লাস)
৫। আবদুল মতিন খান চৌধুরী (আইনের ছাত্র)
৬। আব্দুর রসিদ ভুঁইয়া (এম এ ক্লাস)
৭। হেমায়েত উদ্দিন আহমদ (বি এ ক্লাস)
৮। আবদুল মতিন খান (এম এ পরিক্ষার্থী)
৯। নুরুল ইসলাম চৌধুরী (এম এ ক্লাস)
১০। সৈয়দ জামাল কাদেরী (এম এস সি ক্লাস)
১১। আব্দুস সামাদ (এম কম ক্লাস)
১২। সিদ্দীক আলী (এম এ ক্লাস)
১৩। আবদুল বাকী (বি এ ক্লাস)
১৪। জে পাত্রনবিশ (এম এস সি ক্লাস)
১৫। অরবিন্দ বসু (আইনের ছাত্র), সহ সভাপতি, কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ, ডাকসু।
পনের টাকা জরিমানাঃ ৫ জন
১। শেখ মুজিবুর রহমান (আইনের ছাত্র), পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা
২। কল্যাণ দাস গুপ্ত (এম এ ক্লাস), ঢাকা হল ছাত্রসংসদ
৩। নইমুদ্দিন আহমদ (এম এ ও ল’ এর ছাত্র), আহবায়ক পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ
৪। মিস নাদের বেগম (এম এ ক্লাস)
৫। আবদুল ওয়াদুদ (বি এ ক্লাস)
দশ টাকা জরিমানাঃ ১ জন
মিস লুলু বিলকিস বানু (আইনের ছাত্রী), আহবায়ক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের মহিলা শাখা।
কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের ২০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক হরতাল ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করা হয়।
শাস্তিপ্রাপ্ত অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শর্ত মেনে জরিমানা পরিশোধ করে ও মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব বজায় রাখেন কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শর্ত মেনে ১৫ টাকা জরিমানা পরিশোধ ও মুচলেকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে ফিরে আসার প্রস্তাব শেখ মুজিব প্রত্যাখান করেন। ফলশ্রুতিতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪৯ সালের ১৮ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্রত্ব বাতিল করে তাঁকে বহিষ্কার করে।
৬১ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট এই বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্তে বলা হয়, ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ তৎকালীন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্রত্ব বাতিলের গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের বিষয় বিবেচনা করা হয় এবং তা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
সভায় আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৪র্থ শ্রেণী কর্মচারীদের ১৯৪৯ সালে আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন আইন বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র (রোল-১৬৬, এস, এম হল) শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল ২৬ মার্চ, ১৯৪৯ সালে যে জরিমানা ও অভিভাবক প্রত্যায়িত মুচলেকা প্রদানের ও অনাদায়ে ছাত্রত্ব বাতিলের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, আজকের সিন্ডিকেট সেই সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক ও ন্যায় বিচারের পরিপন্থী হিসেবে গণ্য করে।
সভা মনে করে যে, ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তিকৃত ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন ও নেতৃত্বদান ছিল তার অসাধারণ দূরদর্শী ও জ্ঞানদীপ্ত গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। অধিকন্তু এটি ছিল ঐ সময়ের সাহসী ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিণির্মাণে একটি সাহসী পদক্ষেপ। কর্মচারীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ ছিল যথার্থ। তাকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত অযোক্তিক, অনৈতিক ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী ছিল বলে আজকের সভা মনে করে। তাই ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত উক্ত বহিষ্কারাদেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সর্বসম্মতিক্রমে আজ (১৪/৮/২০১০) প্রত্যাহার করছে।
এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সিদ্ধান্তানুযায়ী জরিমানা ও মুচলেকা প্রদান না করে সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান যে সাহসী প্রতিবাদী ভূমিকা রেখেছিলেন তা এ সভা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪৯ সালে ৪র্থ শ্রেণী কর্মচারীদের আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অন্যান্য যারা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এ সভা তাদের প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে।