১৯৭১-এর একটি ঘটনা
আমার বিশ্বাস এদেশের প্রায় সকল পরিবারেরই ৭১-এর সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কোন না কোন স্মৃতিময় সংশ্লিষ্টতা আছে। হয়ত কালের গর্ভে না বলা কাহিনী হিসেবে সেই ঘটনাগুলো আজ আর উচ্চারিত হয়না। হয়ত কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সেই সব যুদ্ধদিনের কথা। অথবা সেই কথাগুলোকে কালের অতীত গর্ভ থেকে টেনে তোলার কেঊ নেই আজ আর। তবুও বলতে হবে, অজানা সেই ঘটনার গুরুত্ব কোন অংশে কম নয় আমাদের স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে।
এই লেখায় সেই ধরণের একটি ঘটনার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করব, যেটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংঘঠিত হয়েছিল। বিষয়টির গুরুত্ব কিংবা অগুরুত্বের বিচার করবেন এ লেখা যাঁরা পড়ছেন তাঁরা। ৭১ আমি দেখিনি ৭১-এর যা কিছু তা আমার কানে শোনা। সুতরাং শোনা ঘটনাই আপনাদের জানাচ্ছি। ঘটনাটি ঘটে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের দিকে, অর্থাৎ যুদ্ধ শুরুরের কিছুকাল পরে। আমার পিতা ছিলেন তখন একটি হাই স্কুলের শিক্ষক। স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর। মনের মধ্যে দৃঢ় প্রত্যয় দেশের জন্য কিছু করা দরকার। হানাদার পাকিস্থানিদের প্রতিহত বা শায়েস্তা করার প্রতিজ্ঞা মনের মধ্যে তীব্র এক আকাঙ্ক্ষা হয়ে দানা বেঁধে উঠেছে। এই ভাবনা থেকেই পরিকল্পনা করতে লাগলেন কি করা যায়। বুদ্ধি আসল মাথায় বোমা বানাতে হবে। এবং তা দিয়েই প্রতিহত করতে হবে পাক-আর্মিদের। যথারীতি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেমে পড়লেন তিনি। সঙ্গী হলেন তারই কিছু ছাত্র এবং বন্ধু।
আমার পিতা ছিলেন স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক। স্কুলের বিজ্ঞান ক্লাসের ল্যাবরোটারিতেই রাতদিন চলতে লাগল বোমা তৈরির কাজ। উদ্দেশ্য এই বোমা দিয়েই প্রতিহত করা হবে পাকিস্থানিদের। জেলা শহরের উঁচু ভবন থেকে আক্রমন করতে আসা পাক-হানাদারদের উদ্দেশ্যে ছুড়ে মারা হবে ঐ বোমা। এরপর দু,তিনটি বোমাও বানিয়ে ফেললেন তাঁরা। একদিন সবকিছু যখন চুড়ান্ত তখন বোমাগুলোকে অধিকতর শক্তিশালী করার জন্য রসদ জোগাড়ে গেছেন আমার পিতা। আর অন্যরা ল্যাবরেটরিতে তাঁর অপেক্ষায় অপেক্ষমান। এই সময়ে কারো কোন ভূলে বোমাগুলোকে নাড়াছাড়া করতে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়ে গেল একটি বোমা। সেখানে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনজন গুরুতর আহত হন। পরে এর প্রভাবেই তিনজনের একজন অকালে মারা যান। আমার পিতা সেদিন কারণ বশত সেখানে ছিলেন না বলে অক্ষত থেকে যান।
ঘটনাটির গুরুত্ব অন্যদের কাছে কিভাবে ধরা দিবে জানি না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও লেখা হয়নি ঘটনাটি হয়ত কোনদিন হবেও না। কিন্তু দেশ মাতৃকার জন্য এই স্মৃতিময় ঘটনাটির গুরুত্ব কখনও হারিয়ে যাবে না। যা একাত্তরের পটভূমিতে ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তির আকাক্ষায় স্বপ্নময় এজাতীয় অসংখ্য ঘটনা আছে সেই ১৯৭১-এর যুদ্ধের সময়গুলোতে।