১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবি হত্যার ইতিবৃত্ত পর্ব ১ থেকে ১০ : নাঈম
১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর, কারণ এই বছরই সংঘটিত হয়েছিল আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ। ২৫শে মার্চের কালরাত্রে পাকিস্তানীদের অতর্কিত হামলার শুরু থেকে ১৬ই ডিসেম্বরের গৌরবময় বিজয়ের আগ মূহুর্ত পর্যন্ত পাক-হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় কিছু দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-সামস বাহিনীসহ গোটা বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দেবার নিমিত্তে দেশের সব প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করেছিল। বুদ্ধিজীবিদের হত্যা মূলতঃ ১৪ই ডিসেম্বর সংঘটিত হলেও সারা বছরব্যাপী তা বিস্তৃত ছিল। ইংরেজী একটা ওয়েবসাইট থেকে সেই সময়ের বেশ কিছু দলিল পেলাম। সেই ইংরেজী দলিলের বাংলা অনুবাদ নিয়েই আমার এই সিরিজ। আশা করি সবাই মনোযোগ দিয়ে লেখাগুলো পড়বেন এবং অনুধাবন করতে পারবেন যে কি নির্মমভাবে আমাদের দেশের সূর্যসন্তানরা পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছিলেন। প্রত্যেক পর্বের শেষের দিকে সূত্র উল্লেখ থাকবে।
আশরাফুজ্জামান খান-এর কুখ্যাত ডায়েরীর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা (প্রথম অংশ): – লিখেছেন জামাল হোসেন
আশরাফুজ্জামান খান কে? এটা এখন কেন গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা এখন তার ডায়েরীর বিষয়বস্তু জানি? অনুগ্রহ করে ধৈর্য্য ধরুন এবং এই লেখাটি পড়ুন। আমি আপনাকে এই লোকের শাস্তিযোগ্যতা সম্বন্ধে আপনার নিজের উপসংহার টানার সুযোগ দেব।
এটা ছিল ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ –আমাদের নয় মাস দীর্ঘ জ্বলন্ত ও রক্তক্ষয়ী দিনের চূড়ান্ত অধ্যায়ও বটে। আমাদের অদম্য মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় সেনাদের যৌথ কর্তৃত্বের শক্তি ঢাকাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল। কিন্তু যদিও অবরুদ্ধ পাকিস্তানী সেনাদের সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছিল, ভুঁইফোর, যারা গণমানুষের ভাগ্য অস্বীকার করতে চেয়েছিল, তাদের মরণছোবল দেয়ার জন্য অপশক্তিরা গভর্ণর হাউজ এ কাজ করছিল। জেনারেল নিয়াজী তার সাঙ্গ কুখ্যাত মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, এবং তাদের প্রধান সাহায্যকারী মেজর সিদ্দিক সালেক দের সাথে জড়ো হয়ে বসে ছিল। তারা সবেমাত্র একটি তালিকা পেল যা তারা আল-বদর ও আল-শামস-এর কাছ থেকে প্রত্যাশা করছিল। নির্দয় আল-বদর বাহিনীর একজন কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খান গভর্নর হাউজ-এর উচ্চ পদস্থদের সুবিধা’র জন্য সবেমাত্র বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবিদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে। এটা ছিল বুদ্ধিজীবিদের একটি তালিকা যাদের নির্মূল করার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল তাঁদেরকে শীঘ্রই হত্যা করা যাতে করে যদি বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তাদের কাজ করতে হবে ঐ সমস্ত লোকদের ছাড়া যারা ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিটির কাঠামো পুনর্গঠনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে।এটা হত পাকিস্তানীদের বাংলাদেশের প্রতি আংশিক পদাঘাত, তা বলাই বাহুল্য।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের সেই ঘটনাবহুল সপ্তাহের এক মৃত রাতে আশরাফুজ্জামান খানের তালিকার অন্তর্ভুক্ত বহু বাঙালী বুদ্ধিজীবিদের তাঁদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। বলাই বাহুল্য যে, তাঁদের মধ্যে কেউই দিনের আলো দেখার জন্য বেঁচে থাকেননি। এমনকি তাদের পরাজয়ের মুহুর্তেও, জেনারেল নিয়াজী ও রাও ফরমান আলী নিশ্চয়ই এমন চিন্তা উপভোগ করেছিল যে তারা বাংলাদেশকে তার স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত ভারী মূল্য দিতে বাধ্য করেছে। এটা ভাবতে নিশ্চয়ই তাদেরকে কম আনন্দ দেয়নি যে বাংলাদেশ তার এসসম্ত শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবিদের অবদান ছাড়া অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ভেঙ্গে পড়বে।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, নতুন প্রশাসনের তার কাজে মনোনিবেশ করার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় বেশী সময় লেগেছে। তদন্তকারীরা আশরাফুজ্জামান খানের বাসায় আসার সময়ের মধ্যেই সে পালিয়ে যায়। যাই হোক, তাড়াহুড়ায় সে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ ফেলে রেখে যায়। তদন্তকারীরা তার ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজতে গিয়ে তার বাসা থেকে ধাঁধার ঐ অংশটি উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। তারা আশরাফুজ্জামান খানের ডায়েরী খুঁজে পেয়েছিল।সেখানে ছিল তার নিজের হাতে লেখা বুদ্ধিজীবিদের সেই কুখ্যাত তালিকা। এটা ছিল সত্যিই একটি বিভীষিকাময় প্রাপ্তি যা মানুষকে হতবাক করে দিয়েছিল। আশরাফুজ্জামান খান ছিল একজন ফেরারী আসামী। সন্দেহভাজনদের ছবি সকল বাংলাদেশী সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। আসামীদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য জনগণকে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু এসমস্তকিছুই অনেক দেরীতে হয়েছে। আশরাফুজ্জামান তাকে গ্রেফতারের জন্য খোঁজ চলাকালে শুধুমাত্র তার বাসা থেকেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়নি, দেশ থেকেও পালিয়ে যেতে পেরেছিল।
বর্তমানে আশরাফুজ্জামান নিউইয়র্কের সর্বত্র ব্যস্তজীবন অতিবাহিত করছে। সে ঐ শহরের ইসলামিক আন্দোলনের নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করে।আশরাফুজ্জামান খান বর্তমানে উত্তর আমেরিকার ইসলামিক সংস্থার সভাপতি। আমার মনে পড়েছে তার ভয়ংকর অতীতের একটি নতুন ঘটনা যখন আমি Washington Post (November 1, 1999) এর একটি সাম্প্রতিক সংস্করণ পড়ছিলাম। এখানে মিশরের মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনার ব্যাপারে আশরাফুজ্জামান খানের একটি বিবৃতি ছিল। আশরাফুজ্জামান খানের উক্তিতে, “ মাঝে মাঝে আমরা বুঝি যে আমরা অসহায়…….আরেকজন মানুষ তার পিতামাতাকে হারাল। কেউ কিছুই জানেনা। কিন্তু আমাদেরকে আমাদের আল্লাহ্র উপর বিশ্বাস রাখতে হবে।” এই উক্তি সেই মানুষের কাছ থেকে আসছিল যার কুখ্যাত তালিকা ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের সেই হতভাগ্য সপ্তাহে বহু অগণিত শিশুদেরকে পিতৃহারা করেছিল। কি দুর্ভাগ্য, এই ষড়যন্ত্রকারী ১৯৭১ সালে বাঙালী বুদ্ধিজীবি হত্যায় দক্ষ ছিল, বর্তমানে একজন পরিপূর্ণ মানবতাবাদী, এতগুলো বছর পরও! কিন্তু, সে কি মানবতাবাদী? না। সে ভেড়ার চামড়ায় একটি নেকড়ে মাত্র। সে এটাই!
আশরাফুজ্জামান খান-এর কুখ্যাত ডায়েরীর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা (শেষ অংশ):
আমরা বাংলাদেশীরা সম্ভবতঃ নিজস্ব যোগ্যতায় স্বকীয়ভাবে বিবর্জিত। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর জেনারলে নি্য়াজী ও রাও ফরমান আলীর আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এবং বর্তমানে শেখ হাসিনাকে মনে হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট নিহত তাঁর আত্মীয়দের হত্যাকারীদের বিচারে বেশী আগ্রহী। ১৯৭১ সালের হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করতে কারো আগ্রহ দেখা যাচ্ছেনা। আমার কাছে বাংলাদেশের আইনের সবচেয়ে বড় পরিহাস এটাকেই মনে হয়।
অবশ্য আশরাফুজ্জামান খানকে তার অপরাধমূলক অতীতকে তেমনভাবে ভুলতে দেয়া হয়নি। কয়েক বছর আগে ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবির আশরাফুজ্জামান খানের অস্তিত্ব প্রকাশ করেন, বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, সে কোন খারাপ কাজ করেছে-একথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাসম্বলিত বই একাত্তরের ঘাতক দালাল কে কোথায় এর সংস্করণগুলোতে আশরাফুজ্জামান খানের ছবি ও কুখ্যাত ডায়েরীর পাতা শোভা পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সকল রাজ্যে ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির শাখা রয়েছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে এর প্রায় সব সদস্য খুবই তৎপর ছিলেন।তারা এমনকি গোলাম আযম ও তার সাঙ্গদের বিচারের জন্য গঠিত ঐতিহাসিক জনতার আদালতের বিচারকাজে সহায়তা করার জন্য আইনজীবিও প্রেরণ করেছিল।কখন তারা আশরাফুজ্জামান খানের পেছনে ছুটবে? একজন যুদ্ধাপরাধীকে আদালতে জবাবদিহিতায় বাধ্য করা যুক্তরাষ্ট্রে খুব বেশী কঠিন হওয়ার কথা নয়। মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হচ্ছে যে – বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?
-ওয়াশিংটন ডি.সি. থেকে লিখেছেন জামাল হোসেন
“Genocide’71 – an account of the killers and collaborators”, ঢাকায় প্রকাশিত, পৃষ্ঠা – ১৮৯ এ আশরাফুজ্জামান খান ( যে বর্তমানে নিউইয়র্কে এবং কুইনস শাখা, ICNA এর সভাপতি)এর অংশ পাওয়া যায়ঃ
একইভাবে সৌদি আরব কিছু সংখ্যক শীর্ষস্থানীয় আল-বদরকে আর্থিকভাবে সাহায্য করে আসছিল। এখানে আমরা আল-বদরের শীর্ষস্থানীয়দের অন্যতম আশরাফুজ্জামান খানের উদাহরণ দিতে চাই। আশরাফুজ্জামান খান ছিল আল-বদর বাহিনীর সরাসরি ঘাতকদের প্রধানদের মধ্যে অন্যতম। এটা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, সে নিজের হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ জন শিক্ষককে মিরপুরের বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করে। জনৈক মফিজুদ্দিন, যে আশরাফুজ্জামানের এসমস্ত অসহায় শিকারদের বহনকারী গাড়ী চালাচ্ছিল, সে আশরাফুজ্জামানকে বুদ্ধিজীবি হত্যার প্রধান ঘাতক হিসেবে পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করে।
মুক্তিযুদ্ধের পর আশরাফুজ্জামানের ব্যক্তিগত ডায়েরী তার ৩৫০ নাখালপাড়াস্থ বাসা যেখানে সে থাকত, সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। ডায়েরীর দুইটি পাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯জন শিক্ষকের নাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাদের বাসার ঠিকানাসহ দেয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল অফিসার মুহাম্মদ মরতুজার নামও এই ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই ২০ জন ব্যক্তির মধ্যে ১৪ই ডিসেম্বর ৮ জন নিখোঁজ হনঃ মুনির চৌধুরী (বাংলা ), ডঃ আবুল খায়ের (ইতিহাস ), গিয়াসউদ্দীন আহমেদ (ইতিহাস), রাশেদুল হাসান (ইংরেজী), ডঃ ফয়জুল মহি (আই.ই.আর ), ডঃ মুনাজা (মেডিকেল অফিসার)।
মফিজুদ্দিনের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায় যে, আশরাফুজ্জামান এসব মানুষদের তার নিজ হাতে গুলি করে। মফিজুদ্দিনের স্বীকারোক্তির কারণে এই সমস্ত হতভাগ্য শিক্ষকদের ছিন্নভিন্ন শরীর রায়েরবাজারের জলাভূমি এবং মিরপুরের শিয়াল বাড়ি গণকবর থেকে উদ্ধার করা হয়। ডায়েরীতে অন্যান্য নামগুলোর মধ্যে এগুলোও ছিলঃ ডঃ ওয়াকিল আহমেদ (বাংলা), ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম (বাংলা), ডঃ লতিফ (আই.ই.আর), ডঃ মনিরুজ্জামান (ভূগোল), কে.এম.সাদউদ্দীন (সমাজবিজ্ঞান), এ.এম.এম. শহীদুল্লাহ্ (গণিত), ডঃ সিরাজুল ইসলাম (ইসলামের ইতিহাস), ডঃ আখতার আহমেদ (শিক্ষা), জহিরুল হক (মনোবিজ্ঞান), আহসানুল হক (ইংরেজী), সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (ইংরেজী) এবং কবির চৌধুরী।
ডায়েরীর আরেকটি পাতায় পাকবাহিনীর দোসর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ জন শিক্ষকের নাম ছিল। এছাড়াও বুদ্ধিজীবি হত্যার অপারেশনের প্রধান ব্যক্তি চৌধুরী মঈনউদ্দীন, কেন্দ্রীয় আল-বদর শাখার একজন সদস্য শওকত ইমরান এবং ঢাকার বদর বাহিনীর প্রধানের নামও ডায়েরীতে ছিল।
খুন হওয়া বুদ্ধিজীবিদের নাম ছাড়া ডায়েরীতে অন্যান্য বাঙ্গালীদের নাম-ঠিকানা ছিল। তাঁরা সবাই আল-বদরের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। একটি ছোট্ট কাগজের টুকরোতে পাকিস্তান পাট-বোর্ডের অর্থ সদস্য আবদুল খালেকের নাম, তাঁর বাবার নাম, তাঁর ঢাকার ঠিকানাসহ তার বর্তমান ঠিকানা লেখা ছিল। ১৯৭১ সালের ৯ই ডিসেম্বর, আল-বদর বাহিনী আবদুল খালেককে তাঁর অফিস থেকে ধরে নিয়ে যায়। তারা ১০,০০০টাকা মুক্তিপণ দাবী করে। এরপর আল-বদর বাহিনী আবদুল খালেকের কাছ থেকে একটি চিঠি নিয়ে তাঁর বাড়ীতে যায়, যে চিঠিতে তিনি অপহরণকারীদের টাকা দিয়ে দেয়ার জন্য বলেছিলেন। আবদুল খালেকের স্ত্রী ঐ সময়ে ৪৫০ টাকার বেশী দিতে অপারগ ছিলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে বাকি টাকা তিনি তাদের পরে দিয়ে দেবেন এবং তিনি তাদের অনুরোধ করলেন যেন তাঁর স্বামীকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু আবদুল খালেক কখনও ফিরে আসেননি।
আশরাফুজ্জামান কিছু সাংবাদিক হত্যার সাথেও জড়িত ছিলেন। পূর্বদেশ পত্রিকার শিফট-ইন-চার্জ ও সাহিত্য সম্পাদক এ.এন.এম. গোলাম মোস্তফাকে আশরাফুজ্জামান অপহরণ করেছিল।
আশরাফুজ্জামান খান ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য ছিল। স্বাধীনতার পর সে পাকিস্তান যায়। বর্তমানে সে রেডিও পাকিস্তানে কর্মরত আছে।
সর্বশেষঃ এই বই প্রকাশের পর থেকে আশরাফুজ্জামান খান নিউ ইয়র্কে চলে যায় এবং বর্তমানে সে উত্তর আমেরিকার ইসলামিক সংস্থা (ICNA)এর কুইনস শাখার সভাপতি।
ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শন বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অত্যন্ত সন্মানিত একজন শিক্ষক ডঃ জি. সি. দেব এর পালিত কন্যা বেগম রোকেয়া সুলতানা দ্বারা উদ্বৃত একটি সত্যি ঘটনা,ডঃ জি.সি. দেব ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। ২৫শে মার্চ বাঙ্গালীদের উপর সামরিক জান্তা দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার পরদিন, ছাড়া পাওয়া বেগম রোকেয়া সুলতানা ২৬শে মার্চ ডঃ দেব এর মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যিনি কিছুক্ষণ আগে নিহত হয়েছেন। তাঁর একমাত্র শিশুসন্তান রাবেয়া তখন তাঁর কোলে ছিল। রোকেয়ার স্বামীর নিথর দেহও সেখানে পড়ে ছিল।
সন্তানকে কোলে নিয়ে রোকেয়া বুঝতে পারছিলেননা যে কি করা উচিৎ। ভয় এবং প্রচন্ড আঘাতে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। সেই কালো, অন্ধকার রাত্রির অনেকগুলো ঘটনার মধ্যে এটি ছিল একটি, যে রাত বাঙ্গালীদের একটি যোদ্ধার জাতিতে পরিণত করেছিল। মৃত্যুর সংজ্ঞা রোকেয়ার কাছে জানা ছিলনা। কিন্তু তিনি ২৫শে মার্চের সেই চরম কালো রাত্রির একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। ২৬শে মার্চের ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল যা শুধুমাত্র একজনের শেষমুহুর্তগুলোর সাথেই তুলনাযোগ্য। ২৬শে মার্চ সকালে ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেব এলোপাথারি গুলির কারণে রোকেয়ার চোখের সামনেই পড়ে যান। মৃত্যুর কিছু সময় পূর্বে তিনি তাঁর শিশুসুলভ সারল্যতায় পাকিস্তানী সৈন্যদেরকে বাবা (পুত্রতুল্য সম্বোধন) বলে সম্বোধন করছিলেন। তিনি তাঁর বাসায় তাদের আচমকা অভিযানের কারণ জানতে চেয়েছিলেন। এই নিষ্ঠুরতা ঘটানোর পেছনে রোকেয়া কোন প্রাসঙ্গিক কারণ খুঁজে পাননি।
মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় ড. দেব শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেননা। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পায়ে ব্যাথা নিয়ে ফিরে আসেন। মার্চে তিনি দাঁতের ব্যাথায় ভুগছিলেন। ব্যাথাটি এমনকি তাঁর কন্ঠনালীতেও ছড়িয়ে পড়ে। ড. দেব সাধারণত রাজনীতি বিষয়ক কোন আলোচনায় অংশ নিতেন না, কিন্তু মার্চের অসহযোগ আন্দোলন মাঝে মাঝে তাঁকে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন করে তুলত। বাংলা শব্দ মুক্তি তাঁর কাছে বিশেষ অর্থ বহন করত। ২৩শে মার্চ যখন প্রাক্তন ছাত্রনেতা মরহুম আবদুল কুদ্দুস মাখন ড. দেব এর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, ড. দেব তাঁকে (মাখনকে) স্বাধীন বাংলার পতাকা কেনার জন্য স্বেচ্ছায় টাকা দিয়েছিলেন। পরে তিনি বলেছিলেন, এবার দেশের জন্য অর্থবহ কিছু হবে।
২৫শে মার্চ তিনি প্রতিদিনের মত সান্ধ্যকালীন ভ্রমণে বের হন। রাত ৮টায় বাসায় ফেরার পর তিনি তাঁর রিডিং রুমে প্রবেশ করেন। রোকেয়া তাঁকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বলেছিলেন কারণ তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেননা। তাঁর (রোকেয়া) স্বামী মরহুম মোঃ আলী ছিলেন একজন ব্যাংকার। তিনি তাঁর বি.এড. পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সারাদিনের কাজের পর তাঁর স্বামী এবং ড.দেব ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
তখন রাত ১১টা। ক্রমাগত গুলির আওয়াজ রোকেয়াকে চমকে দিল। ভয় পেয়ে তিনি তাঁর স্বামীকে ডাকলেন। সেসময় তাঁরা জগন্নাথ হল এলাকায় বসবাস করতেন। রোকেয়াদের কক্ষ ছিল এক কোণায় এবং ড.দেবের কক্ষ ছিল বাড়ীর মাঝখানে। মোঃ আলী গুলির শব্দে জেগে উঠলেন। তাঁদের কাছে সেটাকে ভূমিকম্পের মত মনে হল। বুলেট ঝড়ের মত বাড়ীটিকে আঘাত করছিল। পুরো বাড়ী কাঁপছিল। মোঃ আলী এবং রোকেয়া তাঁদের শিশুসন্তানসহ মাঝখানের কক্ষে হামাগুড়ি দিয়ে চলে এলেন। ড.দেব ভয় এবং আতংকে থরথর করে কাঁপছিলেন। সন্তানকে মোঃ আলীর হাতে দিয়ে রোকেয়া ড.দেবকে জড়িয়ে ধরলেন। গভীর রাতে এত বেশী গোলাগুলি হচ্ছিল যে, তাঁদেরকে বাড়ীর একটি ছোট্ট কক্ষে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। পাকিস্তানী সেনারা লাউডস্পীকারের মাধ্যমে তাঁদেরকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিচ্ছিল। তারা ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করছিল। ভোর নাগাদ গুলির শব্দ প্রায় থেমে এসেছিল। সারারাত জেগে থেকে ড.দেব খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি প্রায় ধরাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। চরম ক্লান্তি ও পরিশ্রান্তি সত্ত্বেও তিনি রোকেয়াকে বললেন, “মা, এখন প্রার্থনার সময়। তুমি কি আমাকে তার জন্য একটা জায়গা দেবে?” গুলির শব্দ তখন আর ছিলনা। রোকেয়া মাঝখানের ঘরটি পরিষ্কার করে দিলেন ড.দেবের প্রার্থনার জন্য। পাকিস্তানীদের লাগামহীন উন্মত্যতার কারণে পুরো বাড়ীটি এমনভাবে অগোছালো হয়ে পড়েছিল যে, এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে হেঁটে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। দেয়ালে অসংখ্য গর্ত হয়েছিল। দেয়ালের পলেস্তারা খসে আসছিল। মনে হচ্ছিল বাড়ীটি যেকোন মূহুর্তে ভেঙ্গে পড়বে।
মোঃ আলী সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় পড়েছিলেন। ফ্লাস্কে রাখা গরম পানি দিয়ে কোনরকমে এক কাপ চা বানিয়ে রোকেয়া ড.দেবের কক্ষে নিয়ে গেলেন। তিনি চা পান করার পর স্বস্তি অনুভব করলেন।
পাকিস্তানীদের দ্বারা সংঘটিত উন্মত্ততার বর্ণনা দেয়ার সময় রোকেয়াকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। সেটি তাঁর জীবন – বাংলাদেশীদের প্রত্যেকের জীবনে একটি অভিশপ্ত মূহুর্ত ছিল। তিনি বললেন, তাঁর সন্তানও দেখেছে কিভাবে তাঁর পিতামহ নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন। দখলদার শক্তিরা ড.দেবকে শিশুটির সামনে হত্যা করে। “নির্মম সেই হত্যাকান্ডের স্মৃতি এখনও আমার কন্যার মনে জ্বলজ্বল করছে”- এটি মনে করে তিনি (রোকেয়া) ক্রোধান্বিত হয়ে পড়েছিলেন। “সেটা ছিল ২৬শে মার্চের সেই অভিশপ্ত সকাল। পুরো জগন্নাথ হল এলাকা সৈন্যতে পরিপূর্ণ ছিল। আগের রাতে হত্যা করা লাশগুলো ডরমিটোরী বিল্ডিংয়ের সামনে পড়েছিল। নির্যাতিত মহিলাদের আর্তনাদের আওয়াজ আশেপাশের এলাকা থেকেও শোনা যাচ্ছিল। কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থায় আমরা সবাই বাড়ীর মাঝখানের কক্ষে জড়ো হলাম। কিছুক্ষণ পর সদর দরজায় কড়াঘাতের শব্দ এল। কেউ চিৎকার করে বলছিল, “মালাউন কি বাচ্চা, দারওয়াজা খোল দো।” সেটা আদেশ ছিলনা। সেটাকে বর্বর ব্যক্তির গর্জন বলে অনুভূত হচ্ছিল। ভয় পেয়ে ড.দেব সন্ত্রস্থ অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। রোকেয়া তাঁকে জোর করে বসিয়ে দিলেন। দরজায় কড়াঘাতের আওয়াজ ক্রমাগত বাড়তে লাগল। মনে হচ্ছিল তারা তাদের বুটজুতা দিয়ে দরজায় লাথি মারছিল। দরজাটি প্রায় ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।”
শিশুটিকে ড.দেবের কোলে রেখে রোকেয়ার স্বামী দরজার দিকে হেঁটে গেলেন। দরজাটির নির্মম আঘাতের সামনে স্থির থাকার উপায় ছিলনা। তিনি দরজার কাছে পৌঁছামাত্রই সেটি ভীতসন্ত্রস্ত বৃদ্ধের উপর ধ্বসে পড়ল। ড.দেব কোনরকমে ধ্বসে পড়া দরজা থেকে বের হয়ে আসতে সমর্থ হলেন। সাথে সাথে এক সৈনিক রাইফেল দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করল। দূর থেকে একটি গুলি তাঁর বুকে আঘাত করল। তিনি সেখান থেকে সরে আসতে চাইলেন। কয়েক কদম পরেই তিনি মেঝেতে পড়ে গেলেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা মাঝের কক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেখানে মাত্র তিনজন – ড.দেব, শিশুটি এবং রোকেয়া ছিলেন। ড.দেব এতই স্তম্ভিত ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি আক্রমণকারীদের শান্তভাবে “তোমরা এখানে কি চাও বাবা?” জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলেননা। এটা ছিল তাঁর শেষ উক্তি। এর জবাবে তারা তাঁর ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করল। দুটি বুলেট তাঁর মাথায় ঠিক একটি কানের কাছে এবং অন্য গুলিগুলো তাঁর বুকে আঘাত করল। তারা রোকেয়াকেও নির্মমভাবে প্রহার করছিল। তারা বারবার ঘরের কোথায় রাইফেলগুলো আছে জানতে চাচ্ছিল। তারা বারবার ড.দেবের মৃতদেহে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করছিল। সেটা ছিল একটি ভয়ংকর দৃশ্য। রোকেয়া মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লেন যে, তিনি শিশুটিকে তাঁর আরো কাছে টেনে “আল্লাহ্” বলে চিৎকার করছিলেন। তিনি এখনও জানেননা যে ঐ চিৎকারের কারণে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন কিনা। পাকিস্তানীরা ড.দেব এবং তাঁর স্বামী মো.আলীর মৃতদেহ নিয়ে গেল এবং জগন্নাথ হলের খেলার মাঠে শত শত লাশের মাঝে রাখল। এই নির্মম হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের একজন প্রাণপ্রিয় শিক্ষক ও দার্শনিকের জীবনাবসান ঘটল।
ডঃ জ্যেতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজী বিভাগ) (প্রথম অংশঃ)
“আমার বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবি জ্যেতির্ময় গুহঠাকুরতার স্মৃতি, যিনি পাকিস্তানী সেনাদের হাতে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ নিহত হন” – মেঘনা গুহঠাকুরতা
হে বাবা!
যখন আমি ফিরে তাকাই বাগানের চারাগাছ, শীতকালীন ডালিয়া ফুলগুলোর দিকে, আমি আমার শৈশবের স্মৃতিতে ফিরে যাই। দক্ষিণ এশিয়ার শুষ্ক শীতের সকালের বুনো এই রঙগুলোর মাঝে আমি বাবাকে গাছের মরা প্রশাখাকে ছেঁটে ফেলতে, কন্টকময় গোলাপের গুচ্ছ থেকে মরা পাতা তুলে ফেলতে এবং রডোডেনড্রন ফুলের পাতা তুলতে দেখতে পাই। বাগানটি ছিল আমার বাবার প্রাকৃতিক বিচরণক্ষেত্র। তিনি নিজেকে গর্বভরে প্রধান বাগান সংরক্ষণকারী ও তাঁর রাজ্যের রাজা হিসেবে দাবী করতেন, এবং কেউ কোন অবস্থাতেই সেখানে অবস্থিত যেসব ফুল বা চারাগাছের নাম জানত না এবং যাদের কাছে দেয়ালের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন প্রকার জেসমিন ফুলের নিগূঢ় সুগন্ধের কারণে অস্পৃশ্য অথবা সূর্যাস্তে পরিবর্তনশীল অসাধারণ বর্ণচ্ছটার সাথে সংবেদনহীন ছিল, তারা বাগানটিতে প্রবেশে সাহস করতো না। আমার প্রথম দিককার স্মৃতিতে আমি দেখতাম একদল উদ্বিগ্ন কিন্তু অধীর আগ্রহী ছাত্ররা দলবেঁধে আমাদের বাড়ীতে আসত এবং সতর্ক পায়ে হেঁটে হেঁটে আমার বাবার পদচিহ্নের কাছাকাছি তাঁর রাজ্যের ভেতরে আনাগোনা করত। তারা ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র ছিল যাদের Keats and Wordsworth এর কবিতায় সমস্যা হচ্ছিল, বাবার দরজার সামনে পৌঁছাল, তারা আরো বেশী জানার ব্যাপারে তৃষ্ণার্ত ছিল। কিন্তু তারা কি আসলেই জানত তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে!!! প্রথমেই তাদেরকে উজ্জ্বল সূর্যালোকের মাঝে বিভিন্ন রকমের সবুজকে আলাদা করার ক্ষমতা দেখাতে হয়েছিল। তারপর আশেপাশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চারা পরিচর্যা করার সময় পৃথিবীর আচরণ এবং বাড়ন্ত চারাগাছের কিভাবে পানির প্রয়োজন সেসম্পর্কে তাদের গভীর জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল। তারপর এটা অবশ্য পালনীয় ছিল যে উজ্জ্বল বেগুণী, হলুদ, গোলাপী এবং লাল রঙগুলোকে সংগঠিত করা যাতে করে এগুলো ভয়াবহভাবে সাংঘর্ষিক না হয় বরং চারিদিকে আনন্দদায়ক সুর প্রবাহিত করে।
এবং সাহিত্যের, ইংরেজীর, বাংলার প্রতিটি পাতার শিক্ষায় অথবা জীবনে যা কিছুই্ ছাত্রদের জীবনে আসুক, ছাত্ররা আচমকাই তাদের শরীরে রবীন্দ্রনাথ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং ইয়েটসের কবিতার আমার বাবার আবৃত্তির শব্দ কম্পন সৃষ্টি করত।
বাগান করা নিয়ে আমার বাবার শখ শুধু সর্বজন বিদিতই ছিলনা, তা ছিল বিখ্যাত। একবার চারিদিকে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, কলেজের পরীক্ষার জন্য ইংরেজীর প্রশ্ন করার জন্য তাঁকে বলা হয়েছিল। এসব তরুণ পরীক্ষার্থীরা কি ধরণের রচনা পরীক্ষায় আসবে সে ব্যাপারে সাজেশন পাওয়ার জন্য বাবার অনেক ছাত্রদের খাওয়াদাওয়া করাতো। বাবার ছাত্ররা তাদের শ্রমের কারণে ভালভাবে আপ্যায়িত হয়ে একটি সচরাচর কথা বলত, এটা(রচনার বিষয়) অবশ্যই বাগান করার শখ হতে হবে! উল্লাসিত পরীক্ষার্থীরা তাদের মধ্যরাতের তেলের কুপিতে গিয়ে বাগান করার পদ্ধতির সকল দুঃসাধ্য ব্যাখ্যাগুলোর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ত। কিন্তু হায় তাদের বিস্ময়ের সীমা থাকল না যখন তারা পরদিন সকালে প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে তাদের মুখের সামনে শখ হিসে মাছ ধরা সম্বন্ধে রচনা লিখতে বলা হল। বোকা বনে যাওয়া ছাত্ররা যখন আমার বাবাকে একটি ভুল রচনার জন্য রাক্ষসের মত রাতের খাওয়ার কাহিনীটি বলল, তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন কিন্তু তাঁর চোখ উজ্জ্বল বর্ণের ডালিয়া ফুলের মত সংগোপনে মিটমিট করছিল।
ডঃ জ্যেতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজী বিভাগ) (দ্বিতীয় অংশঃ)
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের হতভাগ্য রাতের মাত্র নয়মাস আগে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেয়া নতুন আবাসে স্থানান্তরিত হই। বাড়ীটি ছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ঠিক বিপরীতে এবং ছাত্রদের আবাসিক হল জগন্নাথ হল, যার প্রভোস্ট নিযুক্ত করা হয় আমার বাবাকে – তার পূর্ব দিকের রাস্তার ধারে। আমার বাবা সবসময় চাইতেন নিচের তালার বাড়ী যাতে করে তিনি তার সবচেয়ে প্রিয় কাজগুলো করতে পারেন। আমাদের স্থানান্তরিত হওয়া ফ্ল্যাটটির পেছনের দিকটা ছিল ক্রমাগত জমে ওঠা ময়লা আবর্জনায় পূর্ণ যা বাগানে রুপান্তরিত হওয়ার আগে অনেক কাজ করার ছিল। কিন্তু এটা ছিল একটা চ্যালেঞ্জ যা আমার বাবা গ্রহণ করেছিলেন ঐ স্থানে প্রবেশ করার পর থেকেই। ১৯৭০ সালের শীতের ভেতরেই অবাঞ্চিত গাছড়া পরিষ্কার করা হল, পুরো মাটি খোঁড়া হল এবং বালু ও কাদামাটির মিশ্রণ তার ওপর দেয়া হল যা একটি খাঁটি সবুজের আঙ্গিনার জন্ম দিতে পারে। বিছানাগুলোও বিস্কিট, লেবু, গোলাপী ও গাঢ় খয়েরী – প্রভৃতি বিভিন্ন বর্ণের রৌদ্রজ্বল গাঁদাফুল ও ডালিয়া ফুলের জন্য প্রস্তুত ছিল। এতে করে অনেক পথচারী থমকে দাঁড়াতো এবং দেয়ালের এই দৃশ্যের দিকে তাকাতো এবং আমার বাবার মুখমন্ডল একটা উজ্জ্বল ডালিয়া ফুলের মত গর্ব সহকারে আলোকরশ্মির মত উজ্জ্বল হতো।
কিন্তু হায় সেটা ছিল ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের হতভাগ্য সেই রাত যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সৈন্যরা তাদের অপারেশন সার্চলাইট মিশনে এই অমূল্য বাগানকে পদদলিত করল এবং মূল দরজা অতিক্রম করল অধ্যাপক -এর খোঁজে। এটা ছিল সেই ভালোবাসার আ্ঙ্গিনা যেখানে বাড়ীর সন্মুখদিকে তাঁকে বন্দুকের মুখোমুখি করা হয়েছিল এবং তাঁর নাম ও ধর্ম বলার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আমার বাবা উত্তর দেয়ার সাথে সাথেই গুলি করার আদেশ দেয়া হল। বাবা মুখ ঘুরিয়ে ফেলার সময় ঘাড়ে আঘাত পেলেন এবং একবার তাঁর কোমড়ে যা তাঁকে কোমড়ের নিচের অংশকে অবশ করে ফেলেছিল। তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। সৈন্যরা দল নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ক্যাম্পাসের অন্যান্য জায়গায় তাদের দায়িত্ব পালন করতে লাগল যেখানে নরকের পরিবেশের উদ্ভব হয়েছিল। তিনি চেতনা ফিরে পাওয়ার সাথে সাথেই তিনি আমাদের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। আমরা বুঝতে পারলাম কি ঘটেছিল, যতক্ষণে আমরা ধরতে পারলাম যে তাঁকে গ্রেফতার করে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রতিবেশীরা তাঁকে বাড়ীতে আনার জন্য আমাদের সাহায্য করল, কিন্তু দুই রাত এবং দুই দিন আমরা তাঁকে কোন চিকিৎসা দিতে পারলামনা। সেনাবাহিনীর গাড়ী টহলে ছিল, এবং ডানে-বামে গুলিবর্ষণ হচ্ছিল। এরই মধ্যে সৈন্যদের একটি দল এসে মৃতদেহ সংগ্রহ করে জগন্নাথ হলে খোঁড়া গণকবরে সমাহিত করার জন্য নিয়ে গেল। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান এবং তাঁর পরিবারের তিন ছেলে সবাই সেদিন রাতে গুলিতে নিহত হন এবং তারা তাঁদের দেহগুলো আমাদের তৃতীয় তলায় বসবাসকারী পরিবারের কাছ থেকে টেনে নিয়ে গেল। তারা আমার বাবার শরীর গুণতে ভুলে গেল। আমরা ২৭ তারিখ ভোরেই কার্ফিউ ভাঙার পর তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলাম। তিনি দুর্বল ছিলেন কিন্তু তাঁর জ্ঞান ছিল। কিন্তু ডাক্তাররা বললেন তাঁর দিন ফুরিয়ে আসছে। আঘাতটা খুবই মারাত্মক ছিল। তিনি ১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ সকাল ১০টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আমার মা তাঁর একাত্তরের স্মৃতি তে আমার বাবার সাথে একটি কথোপকথনের স্মৃতিচারণ করছিলেন যখন শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালের মার্চের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে জনতার অসহযোগ আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছিল। অনেকেই আমার বাবাকে ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাবা ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি একজন ছাত্র ক্যাম্পাসে থাকা পর্যন্তও ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে পারতেননা। বরং বিষাদপূর্ণভাবে বাগানের একটি ফুলের টবের দিকে নির্দেশ করে আমার মা-কে বললেন। ফুলের টবটিতে তিন আকারের তিনটি বিস্কিট রঙের ডালিয়া ফুল ছিল। একটি ছিল বড়, একটি দ্বিতীয় মধ্যম এবং শেষেরটি ছিল ছোট। তিনি আমার মা-কে বললেন, “দেখ বাসন্তী, এই তিনটি ডালিয়া আমাদের প্রতিনিধিত্ব করে। আমি হলাম সবার বড়, এটা সবচেয়ে পুরোনো এবং প্রায় মরে যাচ্ছে মাঝেরটা তুমি এবং তৃতীয়টি দোলা (আমি)। যখন আমি চলে যাব এই দুটি তখনও জীবিত থাকবে।” মা তাকে সাথে সাথে থামিয়ে দিলেন এবং এসব চিন্তা বাদ দিতে বললেন। কিন্তু ২৫তারিখ সকালে অবশ্যম্ভাবীভাবে বড় ডালিয়া ফুলটি এতটাই বিবর্ণ হয়ে গেল যে আমার মা তার কান্ড কেটে ফেললেন, বাকী দুটোকে তাদের মত ফেলে রাখলেন।
আমরা আমাদের দুর্বলতম মুহুর্তে এসব ঘটনা স্মরণ করি, যখন আমরা জানিনা যে কিভাবে আমাদের আবেগের সাথে সমঝোতা করতে হবে। আমার কাছে, বাকি দুটো ডালিয়া ফুল আমার বাবার পৃথিবী ও মানবতার প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে প্রদর্শন করে, যা বুলেট বা ঘৃণা দিয়ে হত্যা করা যায়না। তিনি আমাদের এই ভালোবাসা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং ভয় ও ঘৃণাকে জয় করা ছাড়া আর কিছুই চাননি। এ কারণেই যখনই এবং যেখানেই আমি ডালিয়া ফুল ফুটতে দেখি, আমার হৃদয় বিকশিত হয়ে পড়ে আর হাসিতে স্বীকারোক্তি দেয় ….. হে বাবা!!!
অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) (প্রথম অংশঃ)
মুনীর চৌধুরীকে স্মরণ
মুনীর চৌধুরী ছিলেন আমাদের দেশের অন্যতম তুখোড় ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র কয়েক ঘন্টা পূর্বে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর এদেশীয় দোসর ও খুনীদের দ্বারা ১৯২৫ সালের ২৭শে নভেম্বর জন্ম নেয়া এই ব্যক্তির বিখ্যাত জীবন নির্মমভাবে সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত আগ্রহী জাতীয়তাবাদী কিন্তু উশৃঙ্খল ছিলেননা। ছাত্রজীবনে তিনি একজন সক্রিয় কমিউনিস্ট ছিলেন, দলের নিয়মিত সদস্য এবং কার্ডধারী, কিন্তু তিনি সেই সম্পর্ক স্বেচ্ছায় ছিন্ন করেন বহু বছর আগে। তিনি একজন বিদ্যান, একজন অধ্যাপক ও একজন লেখকের জীবন বেছে নেন এবং তিনটি ক্ষেত্রেই তিনি ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করেন। আলিগড়, ঢাকা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে এসে তিনি প্রথমে ইংরেজী সাহিত্যের একজন ভাল শিক্ষক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। তা সত্ত্বেও তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি প্রবলভাবে নিমগ্ন ছিলেন এবং তিনি ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে কারাবরণ করেন যেখানে অন্যান্যদের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর কারাসঙ্গী ছিলেন। জেলে অবস্থানকালে তিনি গভীর মনোযোগের সাথে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেন, জেলের অভ্যন্তরে থেকে তিনি বাংলায় সন্মান (এম.এ) পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন এবং প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। কারাবরণ থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় শিক্ষকতা শুরু করেন, পরে তিনি ঐ বিভাগের চেয়ারম্যান ও কলা অনুষদের ডীন নিযুক্ত হন, যে পদে তিনি ১৯৭১ সালে তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আসীন ছিলেন। মীর মোশারফ হোসেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ব্যাপারে যখন তিনি অননুকরণীয়ভাবে পাঠদান করতেন, অন্যান্য বিভাগ থেকে ছাত্ররা দলবেঁধে তাঁর ক্লাসে চলে আসত। আজ তাঁকে অসাধারণ শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয় যিনি মহান সাহিত্যকর্মের প্রতি তাঁর ছাত্রদের ভেতর উৎসাহ সৃষ্টি করতেন।
মুনীর চৌধুরী সত্যিকারের একটি সৃজনশীল মনের অধিকারী ছিলেন। তিনি অনেক বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন, এবং তিনি বহু ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণের ছাপ রেখে গেছেন। তিনি বাংলা টাইপরাইটারের জন্য একটি কি-বোর্ড এর নকশা করেন যা পূর্ববর্তীগুলোর চেয়ে অনেক উচ্চমানের ছিল। জার্মান এক কোম্পানী দ্বারা বাণিজ্যিকভাবে স্বত্ত্বাধিকার প্রাপ্ত এই কি-বোর্ড মুনির-অপটিমা টাইপরাইটার নামে পরিচিত ছিল। তিনি নাটক, ছোটগল্প, সাহিত্য সমালোচনা, বুদ্ধিদীপ্ত প্রবন্ধ লেখা এবং রম্য ছবি আঁকার পাশাপাশি বহু ইংরেজী নাটককে বাংলায় রূপান্তর করেন। যাই হোক, তাঁর শক্তিশালী দিক ছিল নাটক এবং তাঁকে যৌক্তিকভাবে বাংলাদেশের আধুনিক নাটকের জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শৈশবকাল থেকে তিনি নাটকবিশ্ব সম্বন্ধে প্রবলভাবে আকর্ষিত ছিলেন। স্নাতকের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থাতেই তাঁর একক অভিনীত নাটক রাজার জন্মদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে প্রদর্শিত হয়। তিনি অত্যন্ত আগ্রহভরে বিশ্বের সেরা পুরোনো ও আধুনিক, বিখ্যাত ও আদর্শ নাটকগুলো পড়েছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী, রাশিয়া এবং জাপানসহ বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন, তিনি স্থানীয় থিয়েটার হল এবং অপেরা হাউসগুলোতে ভ্রমণ করে কিছু প্রদর্শনী দেখেছিলেন এবং সমসাময়িক স্থানীয় নাট্যকারদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
মুনীর চৌধুরীর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হল “কবর” যা ১৯৫২ সালের গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা হয়েছে। একদল রাজনৈতিক বন্দীদের দ্বারা জেলের অভ্যন্তরে অস্থায়ী মঞ্চে প্রথমবার মঞ্চস্থ হওয়া কবর সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী কয়েকশবার প্রদর্শিত হয়েছে এবং এই ধারা কখনও হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়নি। তাঁর অন্যান্য নাটকের মধ্যে আছে তিন অভিনেতার একটি ঐতিহাসিক নাটক রক্তাক্ত প্রান্তর, তিন অভিনেতার একটি সামাজিক নাটক চিঠি, গ্লাসওয়ার্দির সিলভার বক্স এর সুন্দর রূপান্তর রূপার কৌটা, বার্নাড শ’ এর ইউ নেভার ক্যান টেল এর অসাধারণ রূপান্তর কেউ কিছু বলতে পারেনা এবং শেক্সপিয়ারের taming of the shrew এর অসাধারণ অনুবাদ মুখরা রমণী বশীকরণ। ঢাকা এবং বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় এই সব নাটকই সফলভাবে মঞ্চস্থ সম্প্রচারিত বা টেলিভশনে প্রচারিত হয়েছে।
তাঁর নাটকগুলো মঞ্চশিল্প সম্বন্ধে তাঁর দক্ষ জ্ঞানকে পর্যাপ্তভাবে প্রদর্শন করে। এগুলো দক্ষভাবে তৈরী করা হয়েছে, সংলাপগুলো প্রবল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও নিরবচ্ছিন্ন এবং এগুলোর বিষয়বস্তু বৃহৎ স্বাধীন মানবতাবাদ দ্বারা চরিত্রায়ণ করা হয়েছে। নাটকগুলো রসবোধ জন্ম দেয়, কখনও কখনও তী্ব্রতা বা ব্যাঙ্গ, কখনও অবাস্তব ও উচ্ছলতার জন্ম দেয় এবং প্রায়ই উচ্চ রসবোধ দ্বারা বিনোদিত করে।
বর্তমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি যদি গণতান্ত্রিক মতবাদ,ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষের সাথে বসবাস করতেন, তিনি আমাদের শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অমূল্য পরিবর্তন করতে পারতেন, কিন্তু উক্ত ধ্যান-ধারণা বিরোধী অপশক্তিরা তাঁকে বাঁচতে দেয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক যে ঐসব স্বেচ্ছাচারী অপশক্তি, ধর্মীয় উগ্রতা ও নিষ্ঠুর অপব্যবহার বাংলাদেশে এখনও আছে, বরঞ্চ এখন তা আরও বেড়ে গেছে। মুনীর চৌধুরীকে স্মরণ করে, চলুন আমরা যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের ঐসব শক্তির হিসাব মেটানোয় পুনঃ উৎসর্গ করি। যদি আমরা তা না করি, বাংলাদেশের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।
অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) (দ্বিতীয় অংশঃ)
আমরা যেন অধ্যাপক মুনীরকে ভুলে না যাই
২০০৩ সালের এই ১৪ই ডিসেম্বর ছিল আমার কীর্তিমান ভাইয়ের অপহরণের ৩২তম বার্ষিকী। আমার ভাই এবং আমি বাইরের বারান্দা থেকে সেন্ট্রাল রোডের আমাদের পূর্বসূরীর বাড়ী দেখছিলাম, ভারতীয় যুদ্ধবিমান আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ছিল, বস্তুতপক্ষে রকেট নিক্ষেপ করছিল একটি ঘরে যেখানে তৎকালীন পাক সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তখন সকাল ১১.৪৫ বাজছিল যখন ভোর ৭টায় শুরু হওয়া গোলা ও রকেট নিক্ষেপ হঠাৎ করে থেমে গেল।
আমার মা নিচের তলার বারান্দার বিপরীত ঘরের ভেতরের ঘর থেকে ডাক দিলেন, “এখন যেহেতু আকাশ হামলা কিছুটা শান্ত হয়েছে, তোমাদের দুইজনেরই দ্রুত গোছল সেরে দুপুরের খাওয়া খেয়ে নেয়া উচিৎ। আমি টেবিল সাজাচ্ছি। ” এই সময়ে আমরা দুজনেই নিচে নেমে আসি এবং আমার ভাই তাঁর গোছলের জন্য গেলেন অস্থায়ী গোছলখানায় যেটা ছিল ঘরের ভেতরের অংশে ছয় গুণিতক তিন ফিট কনক্রিট প্ল্যাটফর্মে যেখানে ছিল একটি বালতি, একটি প্লাস্টিক মগ এবং একটি দশ থেকে বার বালতি পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন পানির ট্যাংক।
এই সময়ে আমি আমার ভাইয়ের গোছল করে ফিরে আমার জন্য জায়গা করে দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন দেখলাম কাদায় আচ্ছাদিত একটি মাইক্রোবাস আমাদের মূল সদরের সামনে থামল এবং প্রায় তিন-চারজন সামরিক পোশাক পরিহিত তরুন যুবক মাইক্রোবাস থেকে নামল। সকলের আয়ত্বেই রাইফেল ছিল। তাদের মধ্যে দুইজন ঘরের ভেতরের অধিবাসীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দ্যেশ্যে বড় গেট থেকে সুসংগঠিত লোহা দ্বারা তৈরী ঝুলন্ত তালা ভাঙ্গার জন্য বিকট শব্দ সৃষ্টি করছিল। আমি নিচের তলার একটি রুমের জানালা থেকে এসব দৃশ্য দেখছিলাম, যে রুম থেকে সদর দরজা ও পাশের রাস্তাসহ সামনের আঙিনার সবকিছু পরিষ্কার দেখা যেত।
আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল উপেক্ষা করা, অপেক্ষা করা এবং দেখা এবং আশা করছিলাম যে তারা তাদের চেষ্টা বাদ দেবে এবং চলে যাবে। এমন কিছুই ঘটেনি। তাদেরকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ দেখাচ্ছিল এবং তখন তারা চিৎকারও শুরু করল। এটা দেখে আমি বাইরে বেরিয়ে আসলাম এবং অজ্ঞাত স্থান থেকে উদয় হওয়া এইসব লোকদের মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এছাড়া আমি তাদের উদ্দ্যেশ্য সম্বন্ধে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলাম কারণ সমগ্র শহরব্যাপী পাক সেনাদের দ্বারা জারিকৃত কার্ফিউ চলছিল। আমি যতই গেটের কাছাকাছি আসছিলাম, বন্ধ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন ব্যক্তির একজন আমাকে গেট খুলে দিতে বলল যার প্রতিউত্তরে আমি বললাম যে আমি তাদের আগমণের কারণ জানতে চাই। তারা তিনজন একইসাথে বলল যে তারা মুনীর স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছে। আমি তখন সামান্য উদ্বিগ্ন হলাম এবং তাদেরকে বললাম যে তিনি দেখা করতে পারবেননা কারণ তিনি অসুস্থ। এই মুহুর্তে তাদের একজন ক্রোধের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল এবং সংক্ষিপ্ত স্বরে আমাকে গেট খুলে দিতে বলল। আমি তাদেরকে আর বেশীক্ষণ আঙিনায় আসতে বাঁধা দিতে পারলামনা। আমার ভাইয়ের অসুস্থতা এবং তাঁর দেখা করতে অপারগতার ব্যাপারে কিছু বাক্য বিনিময় ও তর্ক-বিতর্কের পর আমি সবশেষে লোকগুলোকে (পরে জানতে পেরেছিলাম তারা রাজাকার ছিল) অপেক্ষা করতে বললাম যতক্ষণ না আমি আমার ভাইকে জানাই।
আমি ঘরে ঢোকা মাত্র আমি আমার ভাইকে সিঁড়িঘরের মাঝখানের জানালার সামনে দন্ডায়মান অবস্থায় দেখলাম, তখনও তিনি গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরিহিত ছিলেন। আমি কিছু বলার আগেই , তিনি জানতে চাইলেন লোকগুলো তার সাথে দেখা করতে এসেছে কিনা। আমার কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার পর তিনি আমাকে তাদেরকে অপেক্ষা করার জন্য বলতে বললেন। পাঞ্জাবী, লুঙ্গী ও একজোড়া পাদুকা পড়ে কিছুক্ষণ পর তিনি ফিরে আসলেন। যখন তিনি রাজাকারদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তারা তাকে সম্ভাষণ জানাল এবং বলল যে তারা তাঁকে কিছু জিঞ্জাসাবাদের জন্য পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যেতে এসেছে। এই সময় আমার ভাই তাদের কাছ থেকে গ্রেফতারী পরোওয়ানার মাধ্যমে তাদের অধিকার দেখতে চান। রাজাকারদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ বাক্য বিনিময়ের পর তারা আমার ভাইকে তাদের সাথে যাওয়ার ব্যাপারে জোরও করতে পারলনা কিংবা তাঁর গ্রেফতারের স্বপক্ষে কোন কাগজপত্রও দেখাতে পারলনা। বিষয়গুলো সামনে আসামাত্রই আমার ভাই তাদের সাথে যেতে অস্বীকৃতি জানালেন। যখন আমি সকল কর্মকান্ড তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, রাজাকারদের একজন হঠাৎ তড়িত গতিতে আমার ভাইয়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে তাঁর পেছনে অস্ত্র তাক করে তাঁকে সামনে এগুতে নির্দেশ দিল। ঘটনাবলীর আচমকা মোড়ে আমি সম্পূর্ণভাবে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম এবং আমার ভাইয়ের পেছনে পেছনে অনুসরণ করলাম বাসের দরজা পর্যন্ত। এবং তখন তিনি বাসে উঠার সময় তিনি আমার দিকে ঘুরলেন আর বললেন, “রুশদী (আমার পরিবার আমাকে এই নামে সম্বোধন করত), আমি বরং যাই।”
পরিশিষ্ট
সেই ভয়ংকর ঘটনার পর ৩২ বছর পার হয়ে গেছে, আমি তাঁকে দেখিওনি কিংবা তাঁর কাছ থেকে শুনিওনি। এই দিনে আমি বারবার নিজেকে জিজ্ঞেস করি, “তিনি কি মারা গেছেন? যদি তাই হয়, তবে কে তাঁকে হত্যা করল এবং কেন? তাঁকে কি যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল? যখন শেষ হয়ে আসল তখন তিনি কার কথা ভাবছিলেন? তিনি কি তাঁর মায়ের কথা ভাবছিলেন যিনি তাঁর জন্য খাবার টেবিলে তাঁর সাথে যোগ দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন? অথবা তিনি কি তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানদের কথা ভাবছিলেন যাদের তিনি ফেলে এসেছিলেন? ” আমার মা এই পৃথিবী ছেড়ে গেছেন (জুন ২০০০)। আমি খুশী যে অবশেষে সন্তানের জন্য তাঁর দীর্ঘ ও কষ্টদায়ক প্রতীক্ষা শেষ হয়েছে। আমার কাছে বিশাল ক্ষত তৈরী হয়েছিল যখন থেকে আমার ভাই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু তারপরও আমি কোন কষ্ট অনুভব করিনা। আমি বাঁচতে এবং শোকাবহ পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে শিখেছি। কিন্তু আমাদের প্রিয় স্বদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে আমার জন্য কঠিন হয়। আমাদের দেশের করুণ অবস্থা আমার ব্যক্তিগত ক্ষতিকে ছাড়িয়ে গেছে।
শমসের চৌধুরী ( দি ডেইলী স্টার, ডিসেম্বর ১৫, ২০০৩)
মুনীর চৌধুরী পাকিস্তানী সরকারের দেয়া “সিতার-ই-ইমরাজ” উপাধি ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় পরিত্যাগ করেন
ড.এ.এন.এম. ফয়জুল মাহি – সিনিয়র লেকচারার, ইন্সটিটিউট অফ এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৩৯ সালে ফেনীতে জন্মগ্রহণকারী দীর্ঘকায়, সুদর্শন পুরুষ ডঃ ফয়জুল মাহি প্রগতিবাদী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অন্যান্য সহকর্মীর মত তিনি অতটা উচ্চকন্ঠী ছিলেননা, কিন্তু তিনি মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলমান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তর্পনে সাহায্য করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিমগ্ন থাকা সত্যিই কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু তিনি তাঁর আসল পরিচয় তাঁর দেশদ্রোহী সহকর্মীদের কাছ থেকে গোপন করতে পারেননি। অসহযোগ আন্দোলন বা ’৬৯ এর গণআন্দোলনের সময় স্বায়ত্বশাসনের জন্য জাতীয় আন্দোলন যা পরবর্তীতে দ্রুত স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান , মাওলানা ভাসানী ও অন্যান্য নেতাদের অগ্নিঝরা নেতৃত্বে হয়েছিল, তা বেগবান করতে আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় তিনি সবসময় আমাদের সাথে ছিলেন।
ব্যক্তিগতভাবে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ফয়জুল মাহি আমি যে এলাকায় বসবাস করতাম সেই একই এলাকায় তিনি বাস করতেন। আমরা প্রতিদিন ডিউটিএ অফিস রুম বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে মিলিত হয়ে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতাম। তিনি ছিলেন গভীর জ্ঞানসম্পন্ন একজন বিদ্বান ব্যক্তি।
ডক্টরেট অফ এডুকেশন আর্জন করার পর মাহি ১৯৬৮ সালে ইন্সটিটিউট অফ এডুকেশন এন রিসার্চে যোগদান করেন এবং অতি দ্রুত তিনি সিনিয়র লেকচারার পদে আসীন হন। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক।
বর্বর আল-বদর গ্রুপ তাঁকে ১৪ই ডিসেম্বর ভোরের প্রথম দিকে তাঁর আবাসিক কোয়ার্টার থেকে তুলে নেয় এবং তিনি কখনো পরিবারের কাছে ফিরে আসেননি।
আসুন আজ আমরা এই নীরব কিন্তু নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি।
ড. ফজলুর রহমান খান, সিনিয়র লেকচারার, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ঃ
ড. ফজলুর রহমান ১৯৩৯ সালে ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁদের বিভাগে নীরব কিন্তু নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছিলেন। তিনি মৃত্তিকা বিজ্ঞানে এম.এস.সি ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৬৩ সালে ঐ বিভাগে যোগদান করেন। পরে তিনি উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের উদ্দ্যেশ্যে দর্শনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জনের জন্য যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। সাথে সাথে তিনি তাঁর স্বীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাবর্তন করেন।
আমি তাঁকে একজন নিবেদিতপ্রাণ গবেষক হিসেবে জানতাম, বর্তমান দিনের আমাদের তরুণ সহকর্মীদের মাঝে যা অত্যন্ত দুর্লভ গুণ।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের ভয়াবহ রাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সেনা অভিযানের সময় তিনি নীলক্ষেত এলাকায় তাঁর বাসায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। তাঁর মৃতদেহ কয়েকদিন ফেলে রাখা হয়েছিল, পরবর্তীতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত সেনারা তা নিয়ে যায়।
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ঃ
একজন নম্রভাষী এবং স্বভাবজাত লাজুক প্রকৃতির জনাব চৌধুরী আল-বদরদের হাতে খুন হতে পারেন তা ছিল কল্পনার বাইরে। তিনি কোন দিক দিয়েই সক্রিয় রাজনীতিবিদ বা জনগণের কাছে পরিচিত মুখ ছিলেননা, তারপরও আল-বদর বাহিনী তাঁকে ১৪ই ডিসেম্বর তাঁর বাসা থেকে তুলে নেয় যেখানে তিনি লুকিয়ে ছিলেন। এটা এখন জানা গেছে যে, আল-বদর বাহিনী তাঁর ফুলার রোডস্থ বাসভবনে এসেছিল এবং তাঁর গৃহপরিচারককে জোর করে তুলে নেয় যে তাঁদের অনুপস্থিতিতে ঘর দেখাশোনা করত। গৃহপরিচারককে নির্যাতন করা হয় এবং আল-বদরের হত্যাকারী দলকে অধ্যাপকের গোপন স্থানে নিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়।
জনাব চৌধুরী ছিলেন আমার প্রতিবেশী, ২৫শে মার্চের ভয়াবহ রাতের পূর্বে তিনি আমার বাসার ঠিক বিপরীতে বসবাস করতেন। তারপর কার্ফিউ প্রত্যাহার হওয়ার সাথে সাথে আমরা ২৭শে মার্চ পৃথক হয়ে যাই। তিনি এতই দয়ালু ছিলেন যে, ঢাকায় আমার তেমন পরিচিত লোক বা আত্মীয় নেই জেনে তিনি আমাকে তাঁদের সাহায্যের প্রস্তাব দেন যা আমি নম্রভাবে প্রত্যাখ্যান করি কারণ আমি চাইনি আমার মত রাজনীতিবিদক এবং সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার একজন হিন্দুকে তাঁর সাথে রেখে তাঁকে আরো ভয়ংকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইনি।
১৯২৬ সালে নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণকারী জনাব চৌধুরী ১৯৫৫ সালে বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বে কয়েক বছর অধ্যায়ন করেন। তিনি শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক “সাহিত্য ভারতী” উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি ১৯৭০ সালে বাংলা বিভাগের “রিডার” হন। তাঁর উল্লেখযোগ্য লেখার মধ্যে রয়েছে বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার, রবি পরিক্রমা, কথ্য বাংলা, ভাষা ও সংস্কৃতি, সাহিত্যের নব রূপায়ন ইত্যাদি।
মোহাম্মদ মুরতাজা (ডাক্তার), মেডিক্যাল অফিসার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমি কিভাবে তাকে ভুলতে পারি? আমি তাঁর কাছে ঋণী। তিনি আমাকে পাকিস্তানী বাহিনীদের হাতে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন। আমি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের কোন এক সময় আমার এক ভাল বন্ধুর ধানমন্ডির এক আবাসিক বাসভবনে লুকিয়ে ছিলাম। কিছু সেনাসদস্য নিয়ে সেনাবাহিনীর একটি জীপ দুপুর আড়াইটার দিকে আসল। তারা আমার আশ্রয়দাতা (যিনি পেশায় ছিলেন চিকিৎসক)কে সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক লুকিয়ে আছেন কিনা সে ব্যাপারে অনুসন্ধান করছিল। তিনি কোনভাবে তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারলেন যে তেমন কেউ তার বাসায় নেই। প্রকৃতপক্ষে আমি সেই ফ্ল্যাটে ছিলামনা, আমি ছিলাম তার সাথে কিন্তু মূল ভবনের সাথে সংযুক্ত একটি ছোট ফ্ল্যাটে। আমার বন্ধু আমাকে পরামর্শ দিলেন যে আমার জন্য ঐখানে থাকা নিরাপদ হবেনা কারণ সেনাবাহিনী আবার ফিরে আসতে পারে যদি তাদের কাছে সঠিক তথ্য থাকে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, অন্ততঃ আজ রাতের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হবে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার। কারণ এখানে আসার আগে সেনাবাহিনী অবশ্যই আমার মূল বাসায় খোঁজ নেবে। সন্ধ্যায় কার্ফিউ পুনঃবলবৎ হওয়ার ঠিক পূর্বে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্ল্যাট (তৎকালীন পরিত্যক্ত, নিস্তব্ধ ও ভয়ংকর শান্ত স্থান)-এ বিনা নোটিশে সরে গেলাম। কিন্তু ড. মুরতাজা, যিনি নিচের তলার আমার ফ্ল্যাটের ঠিক বিপরীতে বাস করতেন, আমার আগমন তাঁর জানালা থেকে প্রত্যক্ষ করলেন। সাথে সাথে তিনি আমার স্থানে এসে দরজায় করাঘাত করে আমাকে ফিসফিস করে দরজা খোলার জন্য বললেন। আমি কোন বাতি জ্বালালামনা। তিনি আমাকে ঐ স্থান দ্রুত ত্যাগ করার পরামর্শ দিলেন, সম্ভব হলে আগামীকাল সকালে কার্ফিউ প্রত্যাহার হওয়ার সাথে সাথে। যখন আমি তর্ক করলাম যে যদি তিনি ঐখানে থাকতে পারেন তবে আমি কেন পারবনা, তিনি জবাব দিলেন যে তিনি নামকরা রাজনীতিবিদ ছিলেননা, তিনি ছিলেন মূলত মাওবাদী তত্ত্বে বিশ্বাসী এবং একজন চিকিৎসক। তিনি আমাকে আরো পরামর্শ দিলেন যে যেহেতু এখনও পর্যন্ত আমি একটি নিরাপদ স্থানে যেতে পারিনি, আমার বাড়ি থেকে বের হওয়া উচিৎ নয়, তিনি আভ্যন্তরীণ প্রয়োজনীয় কাজগুলো করবেন। তিনি তাঁর একজন সাহায্যকারীকে আমার জন্য নিরাপদ স্থান খোঁজার জন্যও বললেন। কয়েকদিন পর আমি ঐ বাড়ী ছেড়ে নতুন একটি গোপন স্থানে গেলাম। কিন্তু হায়, ডাক্তার পাকিস্তানী দোসরদের শ্যেন দৃষ্টি থেকে নিজের পরিচয় লুকাতে পারলেননা। তারা জানত যে একজন নিরীহ ডাক্তারের ছদ্মবেশে এই ভদ্রলোক শহরের অভ্যন্তরে অপারেশন চালানো আহত গেরিলাদের চিকিৎসার মাধ্যমে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জরুরী ঔষধপত্র সরবারাহ করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করতেন।
১৯৫৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রী অর্জনের পর তিনি ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিকেল সেন্টারে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দেন। তিনি ছিলেন একজন আন্তরিক লেখক, একজন নিবেদিতপ্রাণ কমিউনিস্ট। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হচ্ছে, চিকিৎসা শাস্ত্রের কাহিনী, প্রাচীন ভিজনানের কাহিনী, হুনানের কৃষক আন্দোলন, পাক-ভারতের যুদ্ধের তাৎপর্য, জনসংখ্যা ও সম্পদ, শান্তি না শক্তি। ১৪ই ডিসেম্বর একদল আল-বদর বাহিনী দ্বারা তাঁকে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন থেকে তুলে নেয়া হয়। তাঁর আদরের ছোট মেয়ে মিতি’র ওড়না দিয়ে তাঁকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়।
আমি শুধুমাত্র আমার একজন অসাধারণ বন্ধুকেই হারাইনি বরং আমার জীবনের একটি অত্যন্ত সংকটময় মূহুর্তে একজন সত্যিকারের শুভাকাঙ্খীকেও হারিয়েছি। আমি কিভাবে তাঁকে কখনো ভুলতে পারব!
মুহাম্মদ সাদাত আলী, লেকচারার ইন এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সত্যি বলছি, আমি তাঁর সম্বন্ধে বেশী কিছু জানতামনা, যদিও আমার মধ্যে সামান্য পরিচয় ছিল। ১৯৪২ সালের ২৮শে জানুয়ারী জন্মগ্রহণকারী, তিনি নরসিংদী জেলার অধিবাসী। American Colorado State College থেকে ডক্টর অফ এডুকেশন ডিগ্রী অর্জনের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পর জনাব সাদাত ১৯৭০ সালের কোন এক সময় আইইআর এ যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পূর্বে তিনি নরসিংদী কলেজে অধ্যাপক ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৬শে এপ্রিল সম্ভবতঃ তিনি গ্রামের বাড়ীর উদ্দ্যেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু তারপর থেকে তাঁর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরে শোনা গিয়েছিল যে নরসিংদী যাওয়ার পথে সম্ভবতঃ তাঁকে সেনাবাহিনী দ্বারা গ্রেফতার করে হত্যা করা হয়।
মুহাম্মদ সাদেক, প্রধান শিক্ষক – ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী স্কুল
জনাব সাদেক ১৯৩৯ সালে ভোলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি ফুলার রোড এলাকায় ১১ নং ভবনের নিচ তলায় বাস করতেন।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ সকালে কারফিউ চলাকালীন সেনাবাহিনী আমাদের এলাকায় অভিযান চালায় এবং জনাব সাদেকের ঘরে জোরপূর্বক প্রবেশ করে। সাথে সাথেই তিনি তাঁর পরিচয় প্রকাশ করার পূর্বে তাঁকে গুলি করা হয়। প্রচুর রক্তক্ষরণরত অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় তাঁকে তাঁর বাসায় ফেলে যাওয়া হয়। পরিশেষে তাঁর ভয়ংকর আঘাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
২৭ তারিখ সকালে যখন কার্ফিউ কয়েক ঘন্টার জন্য প্রত্যাহার হল, তাঁর দেহ ভবনের ঠিক পেছনের সীমানায় মাটি দেয়া হয়।
রাশেদুল হাসান, ইংরেজী বিভাগ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমার খুব ভাল একজন বন্ধু রাশেদুল হাসান ১৯৩২ সালে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন যা ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানী শাসনাধীন উপমহাদেশের এই অংশে স্থানান্তরিত হয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে বি.এ. (অনার্স) এবং ইংরেজীতে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি নরসিংদী, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ও পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের কৃষ্ণচন্দ্র কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে পাঠদান করেন। সর্বশেষে ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। রাশেদুল একজন ভাল বক্তা ছিলেন – ডিইউটিএ সভার বহু অনুষ্ঠানে তাঁর সুচিন্তিত অনবদ্য বক্তৃতা তাঁর সহকর্মীদের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করেছিল।
তিনি মুক্ত গণতন্ত্রমনা এবং মৌলবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে আজীবন যোদ্ধা ছিলেন।
আনোয়ার পাশার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাশেদুল হাসানকে তাঁর বন্ধু আনোয়ার সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর একই ভবন থেকে তুলে নেয়া হয়। ঐসময় দুই পরিবার ক্যাম্পাসের ভেতরে ঈসা খাঁ রোডের একটি ফ্ল্যাটে একই সঙ্গে বসবাস করত।