১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবি হত্যার ইতিবৃত্ত (পর্ব-১৩) (শেষ পর্ব)
সেলিনা পারভীনঃ
সেলিনা পারভীন ১৯৩১ সালে নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন কবি ও সাংবাদিক ছিলেন। তিনি ফেনীতে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন উৎসুক পাঠকে পরিণত হন। সাপ্তাহিক “ললনা” তে তিনি চাকুরী নেন। তারপর তিনি তাঁর নিজস্ব সাহিত্য সাময়িকী “শিলালিপি” শুরু করেন। তিনি কবিতা, ছোট গল্প এবং প্রবন্ধ লেখাও শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আল-বদরের হাতে তিনি নিহত হন।
নিজামুদ্দীন আহমেদঃ
নিজামুদ্দীন আহমেদ ১৯২৯ সালে মুন্সিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সাংবাদিক। তিনি ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বি.এ. (অনার্স) ও এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন। পরে তিনি পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল-এ যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি পিপিআই-এর সম্পাদক হন এবং জেনারেল ম্যানেজার পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
নিজামুদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অত্যন্ত উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। তিনি পাকিস্তানী শক্তির হত্যাযজ্ঞের বিভিন্ন খবরাখবর বিভিন্ন বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে পাঠাতেন। তিনি নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক ম্যাকব্রাউনকে প্রকৃত খবর সংগ্রহের জন্য একটি গেরিলা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বিবিসিকে কঠোর নিয়ন্ত্রণের সাথে প্রকৃত সংবাদ সরবরাহ করেন । এই কারণে তাঁকে দুইবার জেনারেল রাও ফরমান আলীর কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
১৯৭১ সালের ১২ই ডিসেম্বর নিজামুদ্দীন যখন দুপুরের খাবার গ্রহণ করছিলেন, তখন আল-বদর সদস্যরা তাঁকে তাঁর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর দেহ কখনো পাওয়া যায়নি।
কামিনীকুমার ঘোষঃ
কামিনীকুমার ঘোষ ১৮৮৮ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রামে তিনি রায়সাহেব কামিনীকুমার ঘোষ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সকল পরীক্ষায় বৃত্তির সাথে উত্তীর্ণ হন। তিনি ২৮ বছর যাবত চট্টগ্রাম জেলা বোর্ডের সদস্য ও এর সহ-সভাপতি হিসেবে ৭ বছর কাজ করেন। তিনি স্থানীয় স্কুল-কলেজগুলোর সাথেও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। কাঞ্চনা ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি ২৫ বছর কাজ করেন। তিনি সাতকানিয়ায় বহু সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সাতকানিয়া কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। আইনজীবি হিসেবে তিনি ৫০ বছর কাজ করেন।
১৯৭১ সালের ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানী সৈন্যরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
মেহেরুন্নেসাঃ
মেহেরুন্নেসা ১৯৪৬ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শরণার্থী হিসেবে তিনি স্থানান্তরিত হন এবং ঢাকার মিরপুরে স্থায়ী নিবাসী হন। তিনি বহু সংবাদপত্রে প্রুফরিডার হিসেবে কাজ করেছেন ছোটগল্প ও কবিতা লিখেছেন। তাঁর প্রথম কবিতা “চাষী” ১৯৫২ সালে দৈনিক সংবাদের খেলাঘর পাতায় প্রকাশিত হয়।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ তিনি কিছু অবাঙ্গালী মানুষের হাতে মিরপুরে নিহত হন।
সৈয়দ নাজমুল হকঃ
সৈয়দ নাজমুল হক ১৯৪১ সালে খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সাংবাদিক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যথাক্রমে বি.এ. (অনার্স) ও এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬২ সালে সামরিক আইন বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাধা দেয়ার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গর্ভর্নর আবদুল মোনেম খান উপস্থিত ছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ইনফর্মেশন সার্ভিসের জন্য নির্বাচিত হন। কিন্তু সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাধা দেয়ার পুলিশী মামলার কারণে তাঁকে ঐ চাকুরীতে যোগ দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি।
পরে তিনি সাংবাদিকতাকে সার্বক্ষণিক পেশা হিসেবে বেছে নেন। তিনি পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনালের প্রধান রিপোর্টার এবং কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের ঢাকা সংবাদদাতা নিযুক্ত হন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অগ্রগতি নিয়ে তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরী করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা সংঘটিতি হত্যাকান্ড সম্বন্ধে খবরাখবর পাঠান। ১৯৭১ সালের ৬ই আগষ্ট তাঁকে ঢাকায় গ্রেফতার করা হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের একটি কারাগারে প্রেরণ করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি গোপন বিচারে তাঁকে স্বাক্ষ্য দেয়ার জন্য চাপ দেয়া হয়। ১৯৭১ সালে নভেম্বরে মুক্তিলাভের পর তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের ১১ই ডিসেম্বর আল-বদর বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা তাঁকে তাঁর পুরানা পল্টনের বাসা থেকে তুলে নেয়া হয়। তাঁর মৃতদেহ কখনো পাওয়া যায়নি।
সূত্র
বুদ্ধিজীবি হত্যার পেছনে দায়ী মূল ব্যক্তিবর্গঃ
১. মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী (পাকিস্তান সেনাবাহিনী)
২. গোলাম আযম (জামাতে ইসলামী)
৩. মতিউর রহমান নিজামী (প্রধান-জামাতে ইসলামী)
৪. মাওলানা মান্নান (জামাতে ইসলামী)
৫. চৌধুরী মইনউদ্দীন (জামাতে ইসলামী)
৬. খালেক মজুমদার (জামাতে ইসলামী)
৭. দেলোয়ার হোসেন সাঈদী (জামাতে ইসলামী)
৮. সিআইএ এবং আইএসআই