৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও বিএনপি জামাতের তামাশার রাজনীতি
শেখর দত্তঃ দেশের প্রধান দুই শহরের তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে ইতোমধ্যে জনমনে চাঞ্চল্য ক্রমে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। ২৯ মার্চ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। ভোট হবে একই দিনে ২৮ এপ্রিল। ১ ও ২ এপ্রিল বাছাই এবং প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ৯ এপ্রিল। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চিত্রটা কি দাঁড়াবে তা বুঝে ওঠা মুশকিল। এমনিতে আইনানুযায়ী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এমনটাই রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে যে, ইউনিয়ন কাউন্সিল, পৌরসভাসহ সব স্থানীয় নির্বাচনই দলীয় ভিত্তিতে হচ্ছে। পরোক্ষভাবে দল বা জোটই মনোনয়ন দেয় এবং জনগণের বৃহত্তর অংশ স্থানীয় বিবেচনা সামনে রাখলেও সাধারণভাবে দলীয় বিবেচনায়ই ভোট দেয়। বাস্তব এই কারণে স্থানীয় নির্বাচন দলভিত্তিক অনুষ্ঠিত করার একটা জোর মতামত রয়েছে। বলাই বাহুল্য বর্তমান ব্যবস্থায় তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যখন দরজায় কড়া নাড়ছে, তখন এই মতামত নিয়ে এখন আর আলোচনার সুযোগ নেই।
এ কথা দেশবাসী সবারই জানা যে, দেশের রাজনীতির বিশেষ এক পরিস্থিতিতে এই তিন নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর্মি ও নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীল সমাজের জরুরি আইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকাকালীন সময়ে ২০০৭ সালে এর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। যুক্তিসঙ্গত কারণেই ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত করা হয়। এই বিভক্তি যে যুক্তিযুক্ত ও যথাযথ ছিল তা এবারে ঢাকার দুই অংশে প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ফরম জমা দেওয়া ও জনগণের উৎসাহ-উদ্দীপনা থেকেই সুস্পষ্ট। যেসব ব্যক্তি-গোষ্ঠী-মহল ঢাকা সিটিকে দুই কর্পোরেশনে ভাগ করায় তখন সব গেল গেল বলে রব তুলেছিল, তারাও এখন এই নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছে।
বস্তুতপক্ষে, আমাদের দেশের জনগণের কাছে স্থানীয় কিংবা জাতীয় যে নির্বাচনই হোক না কেন, তা হয়ে যায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাথে সাথে উৎসবের মতো। উপরন্তু নির্বাচন হচ্ছে সংবিধান অনুযায়ী গণতন্ত্রকে জীবন্ত ও সচল রাখার অন্যতম প্রধান ফ্যাক্টর। তাই গণতন্ত্রের লড়াই-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে জন্ম এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়া ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ সব সময়েই যথাসময়ে সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে। সর্বোপরি স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া ও জনগণের ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রধান অবলম্বন। কোনো রাজনৈতিক কারণে এই নির্বাচন বন্ধ করে রাখা সমীচীন নয়। এই কারণেই বিভক্তির পরপরই ২০১২ সালে নির্বাচন কমিশন ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিল। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়।
আইনি জটিলতা অপসারিত হওয়ার পরপরই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকার তৎপর হয়ে ওঠে। কিন্তু এতেও বাধা পড়ে। কারণ স্বৈরশাসনের গর্ভে ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেওয়া দল বিএনপি এবং মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী দল জামাতের ২০ দলীয় জোট বছরের শুরু থেকে বিগত নির্বাচনকালীন সময়ের মতো যুদ্ধংদেহী তা-ব শুরু করে। এই জোট লাগাতার অবরোধ ও হরতালের মধ্যে দেশকে ফেলে দিতে অপতৎপরতা চালায়। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে এই জোটের দুর্র্বৃত্ত-সন্ত্রাসীরা তাদের গডফাদারদের উসকানি ও মদতে নিরীহ মানুষ ও যানবাহনে পেট্রলবোমা ও ককটেল মারতে থাকে। এতে মানুষের মৃত্যু হতে থাকলে একসময় মনে হতে থাকে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ও মেয়াদ শেষ হওয়া চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন করা বোধকরি সম্ভব হবে না। কিন্তু দুর্বৃত্ত ও সন্ত্রাসী দমনে সরকারের সাফল্য সুস্পষ্ট এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকলে একসময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার গণতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাস, বিএনপি-জামাত জোটের অরাজকতাকে প্রতিহত করে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক রাখতে পারার সাহস ও মনোবল, জনগণের ইচ্ছা এবং সর্বোপরি গণতন্ত্রকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করতে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করে।
এর ফলেই নির্বাচন হচ্ছে এবং নির্বাচনী বাতাস বিএনপি-জামাত জোটের অবরোধকে নাইরোধে এবং হরতালকে ভয়তাল থেকে নাইতালে পরিণত করেছে। মনোনয়ন জমা দেওয়ার হিড়িক প্রত্যক্ষ করে এখন সহজেই ধারণা করা যায়, পরিস্থিতি-পরিবেশ নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণ অনুকূল। নির্বাচন অনুষ্ঠান করার বিষয়টা কয়েক দিন আগেও বিএনপি-জামাত জোট ও নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীলসহ যাদের কাছে কল্পনার বাইরে ছিল এবং প্রথমে যারা বলেছিল, নির্বাচন করার পরিবেশ নেই; তারাও এখন নির্বাচনের জন্য মাঠে নেমে গেছে। এভাবে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক ও নির্বাচন উপযোগী করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার।
প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয়, উন্নয়ন-অগ্রগতি অব্যাহত রেখে বিদেশি-দেশি চাপ উপেক্ষা করে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া, বিএনপি-জামাত জোটের যুদ্ধংদেহী অপতৎপরতা প্রতিহত করে গণতন্ত্র সুরক্ষায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা, হরতাল-অবরোধ কিংবা পেট্রলবোমা-ককটেল থেকে জনগণকে উদ্ধারের জন্য সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন দিয়ে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দুরদর্শিতা, প্রত্যুৎপন্নতা, দৃঢ়তা, সাহস, মনোবল এবং জনগণ ও গণতন্ত্রের প্রতি ঐকান্তিক ভালোবাসার নিদর্শন রেখে চলেছেন, তাতে জনগণের মনে প্রচ- আশা ও আস্থা সঞ্চারিত হয়েছে। এ কারণেই হরতাল-অবরোধ আহ্বান করলেও তা হয় না। এমনটা দেশের রাজনীতিতে অভিনব বলা যায়। সরকারের প্রতি এমন আস্থা অতীতে আর কোনো সময়েই দেখা যায় নি। এটা জাতির এক দুর্লভ প্রাপ্তি। জনগণ এর উচ্চ মূল্যায়ন করে এবং কামনা করে তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হোক।
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যখন ঘোষণা করা হয়েছে, তখনই লক্ষ্য করা গেছে বিএনপির নেতারা প্রার্থী হচ্ছেন। এতদসত্ত্বেও তখন থেকে আজ পর্যন্ত বিএনপির হাইকমান্ডের আচরণ হাস্যকরভাবে আগ্রহ উদ্দীপক। তামাশারও বোধকরি একটা শেষ আছে। কিন্তু বিএনপির কর্মকা- তামাশাকেও যেন ছাড়িয়ে যায়। চট্টগ্রামে বর্তমান বিএনপির মেয়র মনজুর আলম যেদিন সংবাদ সম্মেলন করে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং ঢাকা উত্তরে উপদেষ্টা আবদুল আওয়াল মিন্টু এবং দক্ষিণে অর্থ বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম মনোনয়নপত্র কেনেন; সেই দিন পত্রিকায় ২০ দলীয় জোট একটি বিবৃতি দেয়। নির্বাচন কমিশনকে ‘ঠুটো জগন্নাথ’ ও আজ্ঞাবহ বলে অভিযোগ উত্থাপন করে ওই বিবৃতিতে বলা হয় যে, ২০ দলীয় জোট যখন আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত ঠিক তখনই চক্রান্তের অংশ হিসেবে সরকার আন্দোলনের গতিধারাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন।
নির্বাচনী তৎপরতা শুরুর সাথে বিবৃতি বিবেচনায় দিলে ‘পাগল ও শিশু’ ছাড়া যে কোনো সুস্থ মানুষেরই মনে হবে বিএনপি দলটি সার্কাসের ক্লাউন ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে রাজনীতির ক্লাউন যে সার্কাসের ক্লাউনের চাইতে বেশি তামাশা করতে পারে; তা বিএনপির বর্তমান কর্মকা- থেকে প্রমাণিত হয়। যতটুকু জানা যায়, বিএনপির বিবৃতি-নাটক পরিচালিত হয় দুই নম্বরি পালানো নেতা লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানের ব্রিফিংয়ে এবং গোপন কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। এই বিচারে বিবৃতিটি হয়ে যায় লন্ডনের পাগল বা শিশুর সুতার টানে দেশে প্রহসনের পুতুল নাচ বিশেষ। বিবৃতিতে নির্বাচন কমিশনকে যা বলা হয়েছে, তা একেবারেই গ্রাহ্য নয়। কেননা দেশবাসীর জানা আছে যে, এই নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে সার্চ কমিটি কর্তৃক গৃহীত নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে বিএনপি মতামত দিয়েছিল এবং সংশ্লিষ্ট সবার মতামত বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল। এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন করে বিএনপি-জামাত জোট কেবল ইউনিয়ন কাউন্সিল, উপজেলা, পৌরসভা নির্বাচনে জিতেছে এমন নয়, সংসদের উপনির্বাচনে পর্যন্ত জয়লাভ করেছে। তাই নির্বাচন কমিশনকে ঠুটো বা আজ্ঞাবহ বলা দেশবাসীর কাছে প্রতারণারই নামান্তর। জন্মলগ্ন থেকে যে দলটি প্রতারক, সেই দলটি নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত যে প্রতারণা করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিবৃতিতে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, তাদের জোট নাকি ‘আন্দোলনে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত’। মানুষ এই কথায় হাসবে নাকি কাঁদবে! প্রলাপের বোধকরি একটা সীমা আছে! মাত্রাজ্ঞান ছাড়া রাজনীতি হয় না, এটা হাওয়া ভবনের কর্ণধার তরুণ তুর্ক মানি লন্ডারিং-এর রেকর্ডধারী তারেক রহমানের বোঝা উচিত। মায়ের কাছে ছেলে সবসময় পাগল ও শিশু থাকতে চায়। তারেক কি তা-ই চাইছে। প্রশ্ন হলো আন্দোলন যদি বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে হয় এবং তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যদি ‘চক্রান্তের অংশ’ হয়; তবে তাতে যোগ দিল কেন? নির্বাচন বয়কটের অভিজ্ঞতা তো বিএনপির রয়েছে। ১৯৮৭ সালে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে স্বৈরাচারী এরশাদকে জেতাতে নির্বাচন বয়কট করে খালেদা জিয়া হয়েছিলেন ‘আপসহীন নেত্রী’। কত ঢাকঢোল পিটিয়ে এই উপাধি প্রচার করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বয়কট করে ‘আপসহীন’ উপাধিটা পুনরায় ঝালিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু অতি চালাকিতে গুড়ে বালি পড়েছে। আম ছালা দুই গেছে। নেত্রীর বিরোধী দলের পদটিও হাতছাড়া হয়ে গেছে। তাই জনগণকে বিভ্রান্ত করতে উল্টাপাল্টা নানা কথার আড়ালে নাকে খত দিয়ে এবারে নির্বাচনে নামতে বাধ্য হয়েছে।
নির্বাচনে নামার পর বিএনপির অন্তত এটা বুঝে উঠতে পারার কথা ছিল যে, হরতাল-অবরোধ ও পেট্রলবোমার সন্ত্রাসী রাজনীতির সাথে নির্বাচনের রাজনীতির ফারাক আকাশ-পাতাল। একটার সাথে আরেকটা খাপ খায় না। একদিকে সন্ত্রাসী অপকর্ম করে পরিবেশকে অরাজকতা-বিশৃঙ্খলার দিকে নিয়ে যেতে চাইবেন; আর অন্যদিকে নির্বাচনের পরিবেশ নেই বলবেন এবং প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন, এমন দুমুখো নীতি-কৌশল গ্রহণ অন্তত গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে হয় না। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে অবরোধ অব্যাহত রেখে হরতাল প্রত্যাহার এবং ২৯ মার্চ আবার গোপন স্থান থেকে হরতাল আহ্বান করে বোমা-ককটেল মারতে উসকানি অব্যাহত রাখার অর্থ সহজেই অনুমেয়। জনগণ তো আর চোখ বুঁজে নেই এবং জাতে মাতাল তালে ঠিক থাকারও ভান করে না। মানুষ বিএনপি-জামাত জোটের ফন্দি-ফিকির সব বুঝে ফেলেছে। প্রকৃত বিচারে এই জোট নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে গণতন্ত্রকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য নয়, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য নয়, সাংবিধানিক ধারায় দেশকে রাখায় জন্যও নয়; রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য সিটি কপোরেশন নির্বাচনকে ব্যবহার করতে চাইছে। একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে, গণতন্ত্র ও সাংবিধান রক্ষা ও উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারা থেকে দেশকে টেনে নামাতে বদ্ধপরিকর হয়ে এই জোট ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকারে নির্বাচনকে কাজে লাগাতে চাইছে।
এই কারণে নির্বাচনের পরিবেশ ও সমান সুযোগের দাবি নিয়ে বিএনপি-জামাত জোট এখন মাঠে নেমেছে। বলে রাখছে পরিস্থিতি দেখে প্রার্থীপদ বাছাইয়ের পর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। বস্তুতপক্ষে পরিবেশ বিষয়ে দেখার কিছু নেই। অকার্যকর ও প্রত্যাখ্যাত হরতাল-অবরোধ ঘোষণা এখন থুক্কু দিয়ে তুলে নিলেই হয়। আর সরকারের তৎপরতার কাছে নস্যি হয়ে যাওয়া বোমা-ককটেল না মারলেই হয়। বিএনপি সংগঠনের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়াচ্ছে যে, বোমা-ককটেল মারা সন্ত্রাসী গডফাদার ও ক্যাডার আর ঘরে বসে থাকা ‘আঙ্গুল চোষা’ নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা চূড়ান্ত রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটাই হয়েছে এখন বিএনপির জন্য কাল। নিরীহ জনগণের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে গডফাদার ও ক্যাডাররা যেমন আতঙ্কগ্রস্ত, তেমনি নেতারও আতঙ্কে থরথর কম্প্রমান। নিজেদের মধ্যে উল্লিখিত এই বিচ্ছিন্নতা ও আতঙ্ককেই এখন রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে নির্বাচনের পরিবেশ নেই বলে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আর সমান সুযোগ! লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড! এটা তো নষ্ট করে নিজ পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে বিএনপি। দ-প্রাপ্ত আসামি ‘দুষ্ট ছেলে’ নাসিরউদ্দিন পিন্টু হয়েছে প্রার্থী। নিজ কর্মগুণেই পালিয়ে বেড়াচ্ছে মীর্জা আব্বাস প্রমুখরা। এসব গুণধররা সমান সুযোগ পাবে কীভাবে? এদের সমান সুযোগ দিতে হলে তো আইনকানুনকে বঙ্গোপসাগরে বিসর্জন দিতে হয়। গডফাদারদের কি নির্বাচন করার সুযোগ দেওয়া যায়? নাকি তাদের নির্বাচন করতে দেওয়া উচিত। এমন তো নয় যে, ঢাকা উত্তরের প্রার্থী ব্যবসায়ী আবদুল আওয়াল মিন্টু কিংবা চট্টগ্রামের প্রার্থী মনজুর আলম সমান সুযোগ পাচ্ছেন না। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেল বিএনপির দুই কেন্দ্রীয় নেতা আমীর খসরু ও নোমানকে দুই পাশে নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে মনজুর আলম মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছেন। তিনি স্বাধীনতা দিবসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী নাসিরের সাথে করমর্দন ও কুশল বিনিময় করেছেন। সহজেই অনুমান করা চলে, বোমা-ককটেল মারার সন্ত্রাসী অপকর্ম ও দুষ্কর্মের সাথে যুক্ত না থাকলে যে কোনো প্রার্থীই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পেয়ে যাবেন।
প্রসঙ্গত বলতেই হয়, নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীল সমাজও নির্বাচনী পরিবেশ ও সমান সুযোগ নিয়ে মাঠ গরম করতে এখন অতি তৎপর হয়ে উঠেছে। এটা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট যে, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমদুর রহমান মান্নাকে দিয়ে এই গোষ্ঠী-মহল ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মাঠে নামতে চেয়েছিল। সুকৌশলে গোপনে মান্না রেখেছিল বিএনপির সাথে যোগাযোগ। বিএনপি-জামাত জোট নির্বাচন না করলে মান্না ওই জোটের আশীর্বাদ নিয়ে নির্বাচনে ম্যাজিক দেখাতে সচেষ্ট ছিল। কিন্তু মান্নার কপাল মন্দ! দুর্ভাগ্য নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীলদের! নিজের ওজন না বুঝে বেশি খেলতে গিয়ে মান্না পড়েছেন ফাঁদে। জেলে থেকে নির্বাচন করে কিছু একটা করে দেখাতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু বিএনপি-জামাত জোট নির্বাচনে সরাসরি নেমে পড়ায় মান্না ও ওইসব সুশীলদের আশায় ছাই পড়েছে। মান্নার মনোনয়নপত্র জমা না দেওয়ার ভেতর দিয়ে সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে এখন সমদূরত্ববাদী সুশীলরা সরে গেছেন ঠিক; তবে নির্বাচন পরিবেশ ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দাবি নিয়ে মাঠে থেকে কার্যত বিএনপি-জামাত জোটকে নির্বাচন করা বা না করা সব দিক থেকেই সহযোগিতা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। বলাই বাহুল্য, নিরপেক্ষবাদী সুশীল সমাজ জরুরি আইনের সরকার ও মাইনাস টু ফর্মুলা জোরালোভাবে সমর্থন করে মুখোশ উন্মোচন করেছিল। আর পরে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও বর্তমান সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং সর্বোপরি মান্নার টেলিফোন সংলাপের ভেতর দিয়ে নিজেদের জাতীয় রাজনীতির মূলধারা তথা আওয়ামী লীগ বিরোধিতার মুখোশ সম্পূর্ণ উন্মোচন করে দিয়েছে। ফলে নির্বাচন পরিবেশ ও সমান সুযোগ নিয়ে তাদের উচ্চবাচ্য নিঃসন্দেহে জনগণ প্রত্যাখ্যান করবে।
সবশেষে পত্র-পত্রিকার খবরে জানা গেল, দলীয় হাইকমান্ড কৌশল নিয়েছে বিএনপি-জামাত জোটের প্রার্থীরা যাচাই-বাছাইয়ের আগে প্রকাশ্যে বের হবে না। এ থেকে দুটো সত্য বের হয়ে আসে। হয় নাটক করতে লুকিয়ে থেকে জনগণের সহানুভূতি পেতে চায় তারা। নতুবা এমন প্রার্থী দেওয়া হয়েছে, যারা লুটপাট কিংবা পেট্রলবোমা মারার আসামি। নির্বাচনে নেমে অপরাধকে তারা জায়েজ করতে চাইছে। এই কৌশল আদৌ কাজে লাগবে না। কারণ ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের জনগণ ইতোমধ্যে স্থির করে ফেলেছে, কোন ইস্যু নিয়ে তারা প্রার্থীকে ভোট দেবে। বলাই বাহুল্য সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, পেট্রলবোমা-ককটেল ও হরতাল-অবরোধ থেকে দেশকে মুক্ত রাখা এবং সর্বোপরি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার বিষয়কেই জনগণ এখন প্রাধান্য দিচ্ছে। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে মানুষের কাছে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি হচ্ছে বর্তমানে প্রধান ইস্যু। দেশের দুই প্রধান শহরের জনগণ আরও হাতিরঝিল, আরও উড়াল সেতু দেখতে চায়। জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা ও উন্নতি-অগ্রগতির যে ধারা দেশে প্রবাহমান, তা অব্যাহত রাখতে চায়। হাওয়া ভবনের যুগে ফিরে যেতে চায় না। দেশের দুই বড় ঐতিহ্যবাহী শহরের জনগণের এই শুভ ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা তিন সিটি কপোরেশনের নির্বাচনের ভেতর দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠুকÑ এটাই নতুন মাস এপ্রিলের একান্ত কামনা।