ইতিহাস : প্রবন্ধ

৪৪ বছরে বাংলাদেশ : অসামান্য আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির সারণি

ড. ফরাসউদ্দিনঃ অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দৃষ্টিনন্দন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও হৃদয় উষ্ণ করা সামাজিক অগ্রগতিকে ‘বিস্ময়’ বলে উল্লেখ করলেও এই অর্জন যে সঠিক নীতি-কৌশল ও সংশ্লিষ্টজনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল, সে সম্পর্কে সন্দেহ করার কারণ নেই। সমসাময়িক বিশ্বের অর্থনৈতিক মহামন্দা ২০০৬-০৯ সাহসিকতার সাথে সফলভাবে মোকাবিলা করে যে গুটিকয়েক দেশ সামষ্টিক আয়ের প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম।
অর্থনৈতিক অগ্রগতি : বাংলাদেশ সম্পর্কে অতীতের নিরাশাবাদী মূল্যায়নের পরিবর্তে বর্তমানে একটি ইতিবাচক ধারণা উচ্চারিত হচ্ছে। গোল্ডম্যান স্যাকসের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি আশু সম্ভাবনার সর্বোচ্চ ১১টির মধ্যে রয়েছে। জেপি মর্গান এক কদম এগিয়ে দেশটিকে অগ্রসরমাণ দেশগুলোর মধ্যে ফ্রন্টিয়ার ফাইভে উন্নীত করেছেন। সিটি গ্রুপের ভবিষ্যদ্বাণী আরও উৎসাহব্যঞ্জক; বাংলাদেশ এখন থ্রিজি অর্থাৎ থ্রি গ্লোবাল গ্রোথ জেনারেটর গ্রুপে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় মূল্যায়ন সংস্থা পিউয়ের এক জরিপে উঠে এসেছে যে বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ লোক তাদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থায় সন্তুষ্ট। সংস্থাটির অন্য একটি মূল্যায়ন অনুসারে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বংশধররা আরও উন্নত জীবন পাবে বলেও মনে করে ৭১ শতাংশ মানুষ। সিএনএনের সাম্প্রতিক একটি মূল্যায়নেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে সাধুবাদ দেওয়া হয়। অর্থনীতির অগ্রগতির পরিমাপে গুরুত্বপূর্ণ মানদ- ভোক্তাসূচকে আস্থা সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ৬৬.৪ শতাংশে উঠে এসেছে। আংটাড ২০১৩ প্রতিবেদনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আকর্ষণীয় বলে উল্লেখ পেয়েছে। বিগত পাঁচ বছরের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ২০০৯ সালে ৭০.১, ২০১০ সালে ৯১.৪, ২০১১ সালে ১১৪, ২০১২ সালে ১২১ ও ২০১৩ সালে ১৬৭ কোটি মার্কিন ডলারের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ এসেছে। তবে প্রতিবছর বিশ্বের ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের তুলনায় এ পরিমাণ একটি কণামাত্র। এর পরিমাণ বাড়ানোর সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল।
রানা প্লাজার দুঃখজনক মর্মান্তিক বিপর্যয় ও অন্যান্য প্রতিকূলতা কাটিয়ে তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার খাত ঘুরে দাঁড়িয়ে রপ্তানি বৃদ্ধির ইতিবাচক ধারার দিকে ফিরে এসেছে। বাংলাদেশের বার্ষিক রপ্তানি ৩ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। এখানে উল্লেখের দাবি রাখে যে পৃথিবীর ৪টি সর্ববৃহৎ অর্থনীতি, যথাÑ গণচীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও জাপানের মধ্যে অন্তত ৩টি বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক সখ্য ও সহযোগিতা গভীরায়নে আগ্রহী। জাপানের ৭১ শতাংশ কোম্পানি বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে ইচ্ছুক। গণচীন বাংলাদেশের সব মেগা প্রকল্পে সহযোগিতা দিতে চায়। ভারতবর্ষ সব দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে সমঝোতামূলক সমাধান করে অগ্রসর হতে চায়। ভারতবর্ষের সাথে দীর্ঘদিনের দুটি বড় ইস্যু তিস্তার পানিবণ্টন ও সীমান্ত চুক্তি আশু সমাধানের দিকে অগ্রসরমাণ। যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের আরও উষ্ণায়নে ইচ্ছুক অংশীদার হতে চায়।
সামাজিক অগ্রগতি : পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, মহামন্দার নেতিবাচক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বার্ষিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বিশ্বব্যাপী হয়েছে ৩.৮ শতাংশ, উন্নত বিশ্বে হয়েছে ২.৩ শতাংশ, অগ্রগামী উন্নয়নশীল দেশগুলোতে হয়েছে ৫.৪ শতাংশ। সে তুলনায় বিগত ছয় বছরে বাংলাদেশের বার্ষিক সামষ্টিক অগ্রগতির হার ধারাবাহিকভাবে ৬.২ থেকে ৬.৭ শতাংশে ওঠানামা করেছে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে গত ৪৪ বছরে বাংলাদেশের সামাজিক অগ্রগতি হয়েছে অসাধারণ গতি ও সারবত্তায়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে জন্মকালীন প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল (লাইফ এক্সপেক্টেন্সি অ্যাট বার্থ) ছিল ৪৩ বছর, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯ বছরে। শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে জীবন্ত শিশুতে ১৭৯-এর তুলনায় প্রতিহাজারে এখন ৩৪। ১৯৭২ সালে জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩.৪ শতাংশ, এখন তা ১.৩ শতাংশ। প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর হার এখন প্রতিলাখে ১৯৪। বাংলাদেশে এখন নারীর সামগ্রিক প্রজনন প্রবণতা নেমে এসেছে ১৯৭২ সালের ৫-এর অধিক থেকে বর্তমানে ২.১-এ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনি¤œ। বাংলাদেশে এখন শিক্ষার হার ৬০ শতাংশের ওপরে। প্রাইমারি ভর্তিতে (এনরোলমেন্ট) প্রায় ১০০ শতাংশ অর্জন, তবে ঝরে পড়ার হার বিগত কয়েক বছরে ৪৮ থেকে ৩০ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। প্রাইমারি ও মাধ্যমিকে ভর্তিতে ছাত্রীরা কিঞ্চিৎ এগিয়ে (মোট সংখ্যার জনমিতিক অনুপাতের অনুরূপ)। উচ্চশিক্ষায় এখন ৩০ লাখ ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত; অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় ১.৯ শতাংশ নিয়োজিত। শিক্ষার মান সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবে কিছুটা প্রশ্নবোধক রয়েছে এবং তা দূর করার প্রচেষ্টা চালু রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া সাড়ে ৬ লাখ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৪ লাখ পড়ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক বিশুদ্ধ খাবার পানি পাচ্ছে। স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশনের সুযোগ পাচ্ছে ৮৯ শতাংশ। শতাব্দী প্রাচীন বৃহৎ সমস্যা ঢাকা মহানগরের পয়োনিষ্কাশন ও পানির লাইন দুটিকে পাকাপাকিভাবে আলাদা করার মেগা প্রকল্প নিশ্চিত গতিতে সমাপ্তির পথে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের একটি বৃহৎ অর্জন দারিদ্র্য নিরসন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে লোক ছিল ৭০ শতাংশ, ১০ বছর আগে ৪২ শতাংশ, এখন তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ শতাংশে। অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণের হার ১৯৭২ সালের ৩ শতাংশের তুলনায় এখন ৪০ শতাংশ।
এখানে উল্লেখের দাবি রাখে যে বরেণ্য অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী প্রফেসর অমর্ত্য সেন, প্রফেসর জোসেফ স্টিগলিজ, ড. মাহবুবুল হক, বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, মুডিজ এবং স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অসাধারণ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, ঋণমান ও চমৎকার সামাজিক অগ্রগতি সম্পর্কে ইতিবাচক মূল্যায়ন করে যাচ্ছে। অতিসম্প্রতি অমর্ত্য সেনের ‘ভারত : উন্নয়ন ও বঞ্চনা’ বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়। অমর্ত্য সেনের মতে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মানবিক প্রগতির একটি নিমিত্ত মাত্র। মানবিক প্রগতির জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সরকারি বিনিয়োগ থাকা জরুরি। সর্বশিক্ষা ও সামগ্রিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরকারি বিনিয়োগ ছাড়া বিশ্বের কোথাও সংঘটিত হয়নি। প্রফেসর অমর্ত্য সেনের মতে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। বিগত চার দশকে এসব মানবিক উন্নয়নে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিশাল পার্থক্য হয়েছে; যদিও ভারতে এ সময়ে সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের মাথাপিছু আয় ৫০ শতাংশ বেশি ছিল। এখন সে পার্থক্য বেড়ে ১০০ শতাংশ হয়েছে। এটা ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতি। তবে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু ভারতীয়দের তুলনায় তিন বছর কম ছিল। এখন ভারতীয়দের তুলনায় বাংলাদেশিদের গড় আয়ু তিন বছর বেশি। নব্বইয়ের দশকে শিশুমৃত্যুর হার বেশি ছিল; এখন ভারতের চেয়ে কম। কন্যাশিশুদের স্কুলে যাওয়ার হার দুই দেশে তখন প্রায় সমান ছিল; এখন বাংলাদেশে বেশি। এসব বিষয়ে বাংলাদেশের কাছে ভারতের অনেক কিছু শেখার রয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক অগ্রগতির কারণ : সত্যি কথা বলতে গেলে বাংলাদেশের বিশ্বনন্দিত সাফল্যের পেছনে মূল কারণ হলো জাতির জনকের শাসনকালে তার উদ্যোগে প্রণীত কৃষি খাতে অগ্রগতিতে ভর্তুকিসহ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, পরিকল্পিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির নীতি, নারীশিক্ষাসহ শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যসেবা, গ্রামবাংলার প্রতি বিশেষ মনোযোগের মাধ্যমে কল্যাণ রাষ্ট্রের সামাজিক সুরক্ষাবলয়ের নীতিমালার সাম্প্রতিক শক্তিবর্ধন। যেসব কারণে বর্তমানকালের অগ্রগতিতে প্রচ- গতি এসেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কৃষাণ-কৃষাণির অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল; যার মাধ্যমে ১৯৭২ সালের ১ কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদন এখন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে সাড়ে ৩ কোটি টন। এর সাথে যোগ হয়েছে শ্রমজীবী মানুষের মেহনত। এর ফলে তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যারে এখন আড়াই হাজার কোটি মার্কিন ডলারের রপ্তানি ছাড়াও ৪০ লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে, যার ৯০ শতাংশ নারী। ৭০ লাখ নাগরিকের বিদেশে ঘামঝরানো অবদানে দেশে বছরে দেড় হাজার কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আসছে। বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের চৌকস ও উদ্ভাবনী শিল্পোদ্যোক্তারা দেশের অগ্রগতিতে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জোরদার উদ্যোগ ও দেশের ঈর্ষণীয় অগ্রগতিতে শক্তি জুগিয়েছেন। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সমস্যার পুরোপুরি সমাধান না হলেও বিপুল অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। লোডশেডিং প্রায় বিলুপ্ত। তবে বিশালভাবে সম্প্রসারণশীল শিল্প খাতের চাহিদা সম্পূর্ণভাবে মেটানো সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি (এনজিও) উদ্যোগে মাইক্রো ক্রেডিটের সাফল্য মানুষকে আশান্বিত, সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করে একটি নীরব বিপ্লব সাধিত করেছে। বিগত বছরগুলোতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নীতির ধারাবাহিকতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া আজকের সুখকর অবস্থানে উঠে আসা সম্ভব হতো না। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক অগ্রগতি, নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডারবৈষম্য দূরীকরণের অবদান অনস্বীকার্য।
বাংলাদেশের অগ্রগতিতে আগামীর সম্ভাবনা ও অন্তরায় : দেশ আজ দৃঢ়প্রত্যয়ী যে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। মধ্য ভবিষ্যতে দেশটি উন্নত দেশগুলোর কাতারে উঠে আসতে পারে। দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক অর্জনের পথে বাংলাদেশের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ বা অন্তরায় রয়েছে, তার সমাধানেই নিহিত আছে প্রযুক্তিনির্ভর জনকল্যাণকামী সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্নের বাস্তবায়ন। বিশ্বে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকোতে অতিকায় বৃহদাকার তেলের মজুদ ও এর উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে আহরণ ও বিপণনের প্রক্রিয়ায় ১০ বছর আগের তুলনায় তেলের দাম এখন এক-তৃতীয়াংশ। এ প্রবণতা অব্যাহত না থাকলেও তেলের দাম আবার বেড়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। ফলে বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষিতে আগের তুলনায় বছরে অন্তত ৩০০ কোটি ডলার সাশ্রয় হবে পিওএল আমদানি খরচে; যা দিয়ে আরও বেশি মূলধনী যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি করে শিল্প সম্প্রসারণে শক্তি যোগ করা যাবে। সে কারণে দেশীয় বিপণনে তেলের দাম এখনই কমানো যাবে না। উৎপাদনের দুই বড় উপাদান শ্রম ও মূলধনী যন্ত্রপাতি পুঁজি প্রতিনিয়ত একে অন্যের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে বা হয়ে থাকে। তীব্র জনসংখ্যার স্বল্পতার সংকটে পড়া উন্নত বিশ্বে শ্রমকে যন্ত্রপাতি মূলধনী পুঁজি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হতো; সে ক্ষেত্রে বর্তমানে সে সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে গেছে। তাই সামষ্টিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে তাদের শ্রমসেবা আমদানি করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো বিগত দিনের অভিশংসন আইনের কড়াকড়ি উঠিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। খুলে যাচ্ছে শ্রমসেবা রপ্তানির বাজার; এতে বিশেষ করে উপকৃত হবে বাংলাদেশ। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড আহরণে সক্ষম ১৫ থেকে ৩৫ বছরে অবস্থানকারী ৫ কোটি মানুষকে বৃত্তিমূলকসহ প্রযুক্তি শিক্ষার মাধ্যমে মানবসম্পদে রূপান্তরে সফল শিক্ষানীতিকে আরও শক্তিশালী এবং দিন ও দিক পরিবর্তনে নিতে হবে। এখানে উল্লেখের দাবি রাখে যে আন্তরিক, গভীর ও আস্থা সৃষ্টিতে সক্ষম আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কওমি মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত কয়েক লাখ বিদ্যার্থীকে তাদের বর্তমান সিলেবাসের অতিরিক্ত হিসেবে দেশ-বিদেশে কদর আছে এমন বৃত্তিমূলক শিক্ষা সরকার প্রদত্ত বৃত্তির টাকায় পড়তে পারার সুযোগ দেওয়া। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী মানবতার বিপক্ষে অপরাধের বিচারকাজ দেশে প্রশংসিত হলেও কোনো কোনো আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত। কিন্তু জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে দেশের সাফল্য প্রশংসিত। সে পরিপ্রেক্ষিতে একটি বড় জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে রূপান্তর করে মধ্যপ্রাচ্যের বড় চাহিদা মেটাতে মানবসেবা রপ্তানি করা সম্ভব হবে। দেশেও এভাবে ক্ষমতায়িত যুব সম্প্রদায়ের অর্থবহ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দুয়ারও খুলে দেয়। এরপর থেকে ন্যূনপক্ষে বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। আর গত ছয় বছরে গড়ে ৬.৫০ শতাংশ। তবে বিনিয়োগ : সামষ্টিক আয়ের অনুপাত এখনো তেমন বাড়ছে না। পাবলিক সেক্টরে বিনিয়োগ হচ্ছে মোট বিনিয়োগের এক-পঞ্চমাংশ, তবে তা অবকাঠামো সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ করে বেসরকারি খাতের চার-পঞ্চমাংশ বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করে। বর্তমান সময়ে পাবলিক সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে তেমন উৎসাহ নেই। এ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ ও নির্মোহ বিশ্লেষণ করে নীতি-কৌশলে যথাবিহিত পরিবর্তন এনে বিনিয়োগ উৎসাহের আবহ সৃষ্টি করতে হবে। একটি সম্প্রসারণশীল অর্থনীতিসহায়ক মুদ্রানীতি ও দেশকালের জন্য যথোপযুক্ত বিনিময় হারনীতিতে যেতে পারলে ভালো হয়। বাজারভিত্তিক অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে সব সংশ্লিষ্ট দেশে উদারনৈতিক মুক্ত ব্যবস্থার কর্মকা- চলবে, তবে আর্থিক খাতকে নিয়মনীতির নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, অন্তত এটাই বর্তমান বিশ্বের অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের হারে ওঠাতে হলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে উল্লম্ফন ধারা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। বিনিয়োগ উৎসাহে বিনিয়োগ বোর্ডকে আরও ক্ষমতায়িত করা যায় কি-না তা ভেবে দেখতে হবে। পাঁচ কর্মদিবসে নিবন্ধনে সক্ষম ওয়ান স্টপ ও সীমিত অনুপাতে হলেও গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানের ক্ষমতা দিয়ে বিনিয়োগ বোর্ডকে আরও কার্যকর করা যায়। তা ছাড়া কেইপিজেডের দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা নিবন্ধন সমঝোতামূলক আলাপ-আলোচনায় বিনিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে সমাধান করে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে ইতিবাচক ইঙ্গিত সৃষ্টি করা উচিত। বলতে দ্বিধা নেই যে কেইপিজেড ইস্যুটি দেশের ভাবমূর্তির জন্য নেতিবাচক। সমুদ্র বিজয়ে যে বিপুল এলাকা, মহীসোপান ও সামুদ্রিক সম্পদভা-ার বাংলাদেশের মালিকানায় এসেছে তার সঠিক সুরক্ষা, লালন ও ব্যবহার করা গেলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পালে তেজি ভাব যুক্ত হবে।
সাম্প্রতিক সুখবর, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল দীর্ঘ সাধনার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ ছাড় এফডিএ ক্লিয়ারেন্স লাভ করেছে। সম্ভবত আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালও এফডিএ ছাড়পত্র পাবে। আর ১২ মাস পর ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালও এ ছাড়পত্র পাবে। এর ফলে সরকারি নীতি ও বস্তুগত সুযোগ-সমর্থন অব্যাহত রাখা ও জোরদার করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বছরে ১ হাজার কোটি ডলারের ওষুধ বিক্রি সম্ভব হতে পারে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে মধ্য মেয়াদে বিনিয়োগের প্রসার ও প্রচেষ্টার গভীরায়ন ক. গ্যাস মজুদের বস্তুনিষ্ঠ সম্ভাব্য ও নিশ্চিত মজুদের পরিমাণ পরিমাপ; খ. দিনাজপুর-রংপুরের ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় উন্নতমানের বিটুমিনাস কয়লাকে বিশেষজ্ঞ প্রত্যায়িত ৫০ বছরব্যাপী ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিতে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ক্ষতিপূরণ মূল্যে ভূমি অধিগ্রহণ, কোলবাংলা কোম্পানিকে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের শেয়ার মালিকানা, তাদের সন্তানদের কর্মসংস্থান, কার্যকরভাবে সন্তোষজনক স্থানান্তর, যথাসম্ভব ন্যূনতম পরিবেশদূষণ নিশ্চিতকরণ; গ. ইডকল ও কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) প্রদর্শিত সফলতার পথে সৌরশক্তিও বায়োগ্যাস বিদ্যুৎ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে অন্তত ২ হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন; ঘ. পাইপে সরবরাহ বন্ধ করে শুধু সিলিন্ডারের মাধ্যমে গৃহস্থালি কাজে গ্যাসের ব্যবহার শুরু করা; ঙ. অত্যন্ত অপচয়প্রবণ গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে শিল্প সম্প্রসারণে গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি করা; চ. ভারত, নেপাল ও মিয়ানমার থেকে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে বিদ্যুৎ কেনা এবং ছ. দেবে আর নেবে মেলাবে মিলিবের পারস্পরিক শক্তি সঞ্চয়কারী উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতায় জলবিদ্যুতে যৌথ বিনিয়োগ, উৎপাদন ও সঞ্চালন বিপণন করে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম জীবনীশক্তি বিদ্যুৎশক্তির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে সমৃদ্ধির জোয়ারে নবতর শক্তি সঞ্চয় করা যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশের সামষ্টিক আয়ের ২৩ শতাংশ আসছে রপ্তানি আয় থেকে। আগামী ১০ বছরে বর্তমানের ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের রপ্তানি রাজস্বকে সাড়ে ৭ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করার পথে ওষুধশিল্পের রপ্তানির সম্ভাবনা ইতোমধ্যে বলা হয়েছে। ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যারকে সাড়ে ৪ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করার সম্ভাবনা অতিশয় উজ্জ্বল। অবকাঠামো সম্প্রসারণ ও নীতি-সমর্থন ছাড়াও পশ্চাৎসংযোগ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার জন্য বস্ত্র খাতে বয়নশিল্পে (বর্তমানে বাংলাদেশ সপ্তম বৃহত্তম বস্ত্র আমদানিকারক দেশ) সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে প্রমাণিত প্রতিভার শিল্পপতি-উদ্যোক্তাদের হাত আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বস্ত্র কিনে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানি করা হলে দেশীয় মূল্য সংযোজন বাড়ে, আমদানি খরচ কমে, কর্মসংস্থানে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি আসে, ৪১-৪২ দিনের লিড টাইম কমে যায় এবং রুলস অব অরিজিনের আইনকানুন মানা সম্ভব হয়। কমে পরনির্ভরতা। তা ছাড়া তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার রপ্তানি খাতে রপ্তানি ঠিকানা ও উন্নত/বিচিত্র ডিজাইনে বহুমুখীকরণ করা সমীচীন হবে।
সাভারে চমৎকার বিসিক নগরীতে সেন্ট্রাল শোধনাগারসহ চামড়াশিল্পের স্থানান্তর আর বিলম্ব না করে সম্পন্ন করা হলে বিশাল সম্ভাবনাময় এ খাতের রপ্তানি আয় অনেক বেড়ে যেতে পারে। এমনকি ১ হাজার কোটি ডলারে উঠে আসতে পারে।
রপ্তানি ও অর্থনীতির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে নিশ্চিত ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে মান নির্ধারণ করার উদ্দেশে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটকে (বিএসটিআই) একটি বিশ্বমানের আধুনিক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করা জরুরি।
গ্যাস যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শিল্পায়নে আনা যায় এবং আরও গ্যাস যদি পাওয়া যায়, তা হলে বেশি বেশি গ্যাস ব্যবহারপ্রবণ তবে বিশ্বে বিপুল চাহিদাসম্পন্ন সিরামিকস তৈজসপত্র খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি বিপুলভাবে বাড়তে পারে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।
অপ্রচলিত খাত খেলাধুলার সরঞ্জাম, সাইকেল, রাবার ও প্লাস্টিকসহ অন্যান্য হালকা শিল্পপণ্য, খাদ্যসামগ্রী, পাটজাতপণ্য, কারুপণ্য, ফুল ও সবজি রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আসতে পারে। রাশিয়া ও ভারতে আলু রপ্তানির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
তবে শিল্পায়নে গতি প্রচ- করতে হবে এবং তা বহুবিধভাবে বাড়াতে হবে। রপ্তানি উৎসাহ ছাড়াও আমদানি প্রতিস্থাপক চিহ্নিত করে তার বর্ধন ও লালন করা সমীচীন হবে। উচিত হবে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী অতিক্ষুদ্র (মাইক্রো) ও ক্ষুদ্র শিল্প প্রসারে পরামর্শ, অত্যন্ত সহজ শর্তে ঋণদান, বিপণন সহায়তা ও নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করাÑ এসব পদক্ষেপ বার্ষিক সামষ্টিক আয়বৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত করতে অবদান রাখবে।
পরিশেষে : ভারতবর্ষের নতুন বাজেটে ৮ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে এবং এটা অর্জনে ব্যাপক ফিসক্যাল সহজীকরণ সুযোগ (করপোরেট কর ৩০ থেকে ২৫ শতাংশে হ্রাসসহ) দেওয়া হচ্ছে। গণচীন ইতোমধ্যে ৮-৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে অগ্রগতির রাস্তা ধরেছে। ভারতবর্ষ পারস্পরিক স্বার্থেই বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে। থাইল্যান্ডের কাছ থেকেও অনেক কিছু জানা ও শেখার আছে। আর সিঙ্গাপুর তো উন্নয়ন মডেলই। তাই বাংলাদেশে এর চমৎকার কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের সুযোগ থেকে দ্রুতগতিতে বার্ষিক সামষ্টিক আয় প্রবৃদ্ধি (২০২০ সাল নাগাদ ১০ শতাংশ) ও মানবসম্পদ সূচকে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ ধাপে ওঠার পথে (হাইয়েস্ট এইচডিআই) নিশ্চিত পদক্ষেপ নিতেই হবে। তবে অর্থনীতির জীবনীশক্তি ক্ষয়কারী অহেতুক রাজনৈতিক সহিংসতা, পেট্রলবোমায় খুন-খারাবি, ককটেল ও গুপ্তহত্যা বন্ধ করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে জোরদার উদ্যোগ নেবে, সেটাই আজ কাম্য। আর তা অবিলম্বে বন্ধ করতে না পারলে সব অর্জন ভেস্তে যেতে বাধ্য।

লেখক : অর্থনীতিবিদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *