৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা
৭ মার্চ ,১৯৭১ বাঙালি জাতির জন্য একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুচনার সময়। ৭ মার্চের অগ্নিগর্ভ ভাষণের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি ও ঘোষণার কৌশলী প্রয়াস ঘটে।“ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম” বজ্রনির্ঘোষ উচ্চারণই মুক্তিযুদ্ধের সবুজ সংকেত এবং ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার দ্বিধাহীন নির্দেশ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৈশর বয়স থেকেই বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেণ।’৫২ এর ভাষা আন্দোলন,৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন,’ ৫৮ এর সামরিক শাষন বিরোধী আন্দোলন , ’৬৬ সালের ছয়দফা, ’৬৯ এর গণঅভ্যুন্থানসহ প্রতিটি ঘটনা শেখ মুজিবকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তৈরি করেছে। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সারা পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের জয়জয়কার। এত দিনে ধীরে ধীরে শেখ মুজিব প্রস্তুত করছিলেন বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য। বাঙালিরা খুঁজে পেলেন তাদের মুক্তির দিশারীকে। তিনি যখন বুঝলেন এখন সময় এসেছে তাই তো ৭ই মার্চ ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু সেই রেসকোর্স ময়দানে সুবিশাল গণজমায়েতে ঘোষণা করলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ৭ই মার্চের ভাষণের পর সকল স্তরের মানুষ বুঝে গেলেন তাদের কি করতে হবে। আসলে এমন দিন, ক্ষণ একটি জাতির জীবনে খুব কমই আসে।
এ দেশে অনেক নেতার জন্ম হয়েছে। অনেক নেতা শোষিত মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন। বিচক্ষণ বহু নেতাই পাল্টে দিতে চেয়েছেন দেশের চেহারা।কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন আপাদমস্তক ‘নিজের মানুষ’কে এতো দিন খুঁজে পায়নি বাঙালি। জনগণ তার মধ্যে যেন দেখতে পেল নিজের অববয় । তাঁর বলা কথা হয়ে গেল বাঙালির নিজস্ব কণ্ঠস্বর। সেই অসাধারণ সাত দিনকে আনা যাক ভাবনায়। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। অবিশ্বাস্য বড় জয় পেয়েছে দলটি। শেখ মুজিবুর রহমান তত দিনে ছয় দফা,আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পথ ঘুরে এই ভূখণ্ডের মানুষের নয়নের মনিতে পরিণত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে ‘পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী’ বলে উল্লেখও করেছেন। ১ মার্চ ইয়াহিয়া দেন বেতার ভাষণ। তিনি তার ভাষণে ৩ মার্চের অধিবেশন স্থগিত করেন। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে বিবৃতি দেন ,তাতে স্পষ্ট ভাষায় বলেন,’বাঙালিকে আর দমন করিয়া রাখা যাইবে না। ৭ই মার্চ পর্যন্ত কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি.৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন ভোর ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত প্রদেশব্যাপী হরতাল। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসমাবেশ।
৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্র। বাতাসে উড়ছে অসংখ্য পতাকা,সোনার বাংলার মানচিত্র আকা লাল সূর্যের পতাকা, শ্লোগানের সাথে সাথে উত্থিত হচ্ছে আকাশের দিকে বাঙালীর সংগ্রামের প্রতীক বাঁশের লাঠি, অসংখ্য লাঠি। মঞ্চে মাইক থেকে শ্লোগান দিচ্ছে জনতা- “জয় বাংলা,” আপস না সংগ্রাম-সংগ্রাম, সংগ্রাম,” আমার দেশ, তোমার দেশ- বাংলাদেশ। “বীর বাঙালী অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর,” বিকাল ৩:২০ ঘটিকায় বঙ্গবন্ধু সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন। তিনি তার বক্তৃতার শেষে এক অবিস্মরণীয় এক ঘোষণা দেন,” ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ঘোষণা মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। ৭ই মার্চের ভাষণ এ স্বাধীনতার ঘোষণা ও নির্দেশনা ছিল যেমন “ প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।“ তিনি যে সকল মানুষের প্রতিনিধি তা বুঝিয়ে দিলেন তার দৃঢ় উক্তি “ সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না,” তার ভাষণের মধ্যে কুটনৈতিকত সুক্ষ ছোঁয়া রেখেছেন এই বলে “ সামরিক আইন মার্শাল-ল উইথড করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ঢুকতে হবে। যে ভাইদের হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে——-।’’ এভাবে তিনি নিজেকে আন্তর্জাতিক নেতার কাতারে নিয়ে গেলেন।
৭ই মার্চের ভাষণ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা। বাঙালি জাতির আকাক্ষার পূর্ণ প্রতিফলন- বাঙালির হৃদয়ের নিংড়ানো সবটুকু প্রতিবাদ, স্বাধীনতার ঘোষণার একটি খেতাবি ভঙ্গি । সকল শ্রেণির সকল বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতার মুখ থেকে উচ্চারিত সবচেয়ে সুন্দরতম কথাগুলি, এর ভিতর সুস্পষ্ট ঘোষনা, নির্দেশনা, প্রতিবাদ সবকিছুই থরে থরে সাজানো ছিল; ঠিক যতটুকু প্রয়োজন ছিল ততটুকু । এর পর স্বাধীনতার কোন ঘোষণা বাকি ছিল বলে আমি মনে করি না।