বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নামমুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা

কবি আল মাহমুদ কি আসলেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন? আশির দশকের শুরু পর্যন্ত এই নিয়া কেউ ফালাফালি করে নাই। এইটার হাই লাইট করা হইছে তার জামাতি কানেকশানের পরে।

প্রসঙ্গ উঠেছিল হাসান মোরশেদের একটি পোস্টে শামসুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ কেন ?এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে গিয়ে হাসান মোরশেদ এক জায়গায় লিখেছিলেন -রাহমানের সমালোচনা করে কেউ কেউ মনে করিয়ে দিতে ভুলেননা আল মাহমুদ কিন্তু অস্ত্রহাতে মুক্তিযোদ্ধা ।

তিনি আমার কথার প্রসঙ্গে আরো মন্তব্য করেন -এমন ও প্রচার করা হয়, এই হুজুরই নাকি ‘একমাত্র’ কবি যিনি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন, বাকী বদমাশগুলো কলকাতায় বসে মদ আর মাগীবাজী করেছে ।

আমি তখন বলি -এই বিষয়টি নিয়ে আমার কৌতুহল আছে ।আজ পর্যন্ত কোথাও পেলাম না যে উনি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন ।‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌যাই হোক , একটু সময় পেলে বিষয়টি ঘেটে দেখব ।
হাসান মোরশেদ খুঁচিয়ে দেন -ঘাঁটানো দরকার ।

কারো চরিত্র চিত্রন আমার উদ্দেশ্য নয় । আল মাহমুদকে আমি খুবই শক্তিমান কবি হিসেবে মানি , তার রাজনৈতিক দূ:খজনক বিবর্তন সত্ত্বেও যে কয়জন কবি আমাদের সময়কে প্রতিনিধিত্ব করবেন , তাদের মাঝে আল মাহমুদের নাম প্রথম সারিতেই রাখতে হবে । যদিও তার ইদানিংকার মোনাজাত জাতীয় কবিতা পাঠক হিসেবে আমার পছন্দের তালিকায় নেই , তারা সাম্প্রতিক কবিতার বইটি আমি ফেলে দিয়েছি , তবু তার আগের লেখাগুলোর কারনেই তার অবস্থান আমার মনে অনেক উচ্চ আসনে রয়েছে ।

আল মাহমুদের কাব্য বিচারের সাধ বা সাধ্য কোনটাই আমার নেই । আমি শুধু তার মুগ্ধ পাঠক ।

কিন্তু জটিলতা সৃষ্ঠি হয় যখন তার রাজনৈতিক অবস্থানটি আলাদা ভাবে আমাদের বিচার্য হয়ে ওঠে । সেই জায়গায় আল মাহমুদ আমার প্রতিপক্ষ দলে অবস্থান করেন ।
তাই যখন আমার প্রতিপক্ষ দল গর্বের সাথে বলে – দেশের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা কবি তাদের শিবিরে অবস্থান করেন , তখন আমি হতাশ হয়ে পড়ি । শামসুর রাহমান কেন নিজের গ্রামে বসে ”স্বাধীনতা তুমি ” কবিতাটি ছদ্মনামে লিখে সেটা স্বাধীন বাংলা বেতারে পাঠিয়ে দায় সারলেন , তিনি কেন আল মাহমুদের মতো সশস্ত্র হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন না , সেটা নিয়ে আফসোস করতে থাকি ।
কিন্তু বহুদিন ধরেই আমি কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না আল মাহমুদ কোন সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন । হাসান মোরশেদের ” ঘাটানো দরকার” মন্তব্যটি আবার আমাকে খুঁচিয়ে তুলে ।
গত কয়দিন ধরে কিছু বই ঘাটাঘাটি করছিলাম ।কিন্তু কোথাও এই বিষয়ে কিছু পেলাম না ।

আজ এক কাজিনের বই আলমারিতে অন্য একটি বই খুঁজতে গিয়ে পেয়ে গেলাম স্বয়ং আলমাহমুদের আত্মজীবনী । বইটির নাম ”বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ ।” প্রকাশক : একুশে বাংলা ।

আসুন , সেখান থেকে কিছু অংশ পড়া যাক :

৭১ সালে ভারত পাড়ি দেয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে কবি জানাচ্ছেন :

” আমার ভগ্নিপতি পার্বত্য চট্টগ্রামের ডিসি হোসেন তৌফিক ইমাম সেখান থেকে সপরিবারে আরগতালায় পৌছেছেন । ….জেনে আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম । এ পরিস্থিতিতে নারায়ণপুরে আমি নিরাপদ ছিলাম না । মনে মনে দেশত্যাগ করে চলে যাওয়ার একটা আকাঙ্খাও জেগে উঠেছিল ।”

যাক , না না বিপর্যয় পেরিয়ে আল মাহমুদ অবশেষে কলকাতা পৌছান ।

তিনি সেখানে তৌফিক ইমামের বাসাতেই আশ্রয় নেন ।
তবে মুক্ত পরিবেশেও কবিকে বেশি সাহসী বলে মনে হচ্ছে না , কারন তিনি বলছেন :

“এখানে এসে উডস্ট্রিট থেকে আমি একদম বেরুতাম না । কারন অতি কৈশোরে আমার খানিকটা জানা থাকলেও ওই সময়ে তা আগের মতো থাকার কথা নয় । আমি ভয় পেতাম ঠিকমতো বাসায় এসে পৌছতে পারব না । ”

অর্থাৎ কবি আসলে নিজের বাসায় ফেরার ব্যাপারেই বেশি কাতর ছিলেন দেখা যাচ্ছে ।

যদিও পরের প্যারায় উনি জানাচ্ছেন :
“আমি নয়মাস কলকাতায় অবস্থানকালে আমার প্রধান নেশাই ছিল কলকাতাকে জানা । এ ব্যাপারে যারা আমাকে সাহায করেছিলেন কলকাতার ওপর বই লিখেছেন সেই পুর্ণেন্দু পত্রী এবং কবিতা সিংঞের মেয়ে রাজেশ্বরী রায় চৌধুরী ।”

অর্থাৎ , কবি নয়মাস কলকাতাতেই ছিলেন এবং পূর্ণেন্দু পত্রী আর রাজেশ্বরী রায়ের সাথে কলকাতাকে জানতেই তার সময়টি ব্যয় হয়েছে । দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতাকে জানাটা যদি কবির কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় , তাহলে তাকে আর যাই হোক মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলিয়ে ফেলাটা মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা ছাড়া আর কিছুই নয় ।

তারপর কবি বিভিন্ন বর্ণনায় জানাচ্ছেন , তাকে পেয়ে কলকাতার কবিকূল কেমন খুশী হয়েছিলেন । এই পর্যায়ে আমাদের গৌরবান্বিত হওয়ার অনেক তথ্যই আছে ।

কিন্তু যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এতো কথা ,সেখানে কবির ভুমিকা কী ?

“ততদিনে আমার ভগ্নীপতি প্রবাসে বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহন করেছেন । আমি তখনো তার সঙ্গেই আছি । এর মধ্যে আমার দায়িত্ব বেড়ে গেল । ”

কী সেই দায়িত্ব , সেটা জানতে হলে পড়তে হবে পরের লাইনটি ।

” বিভিন্ন পত্রিকায় আমার সমর্থন একটু -আধটু সমর্থনসূচক প্রতিবেদন ছাপা হতে শুরু হয়েছে ।”

অর্থাৎ , কবি তখন আত্মপ্রেমে মগ্ন হয়ে সেই পত্রিকার কাটিং জোগাড় করে চলছেন ।
তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সাথে তার সংযুক্তি কোথায় ?

আছে এর পরের লাইনে ।
উনি জানাচ্ছেন ,
” তা ছাড়া আট নম্বর থিয়েটার রোডে মুক্তিযুদ্ধের মূল অফিসের স্টাফ হিসেবে আমার নাম থাকায় আমি একটি পরিচয়পত্র পেয়ে গেলাম । এটা ছিল আমার জন্য একান্ত জরুরী । কারন তখন কলকাতায় চলাফেরা করার জন্য এই পরিচয়পত্রটি থাকা দরকার ছিল । ”

এই পরিচয়পত্রটি নিয়ে উনি কী করেছেন ?
” আমাকে কেউ কোন নির্দিষ্ট দায়িত্ব না দিলেও আমি কলকাতার লেখক , শিল্পী , ও সাহিত্যিকদের মধ্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন যোগানোর কাজ করে চলছিলাম ।”

কলকাতার লেখক , শিল্পী , ও সাহিত্যিকগন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কেউ ছিলেন বলে জানা যায় নি কোনদিনই , তখনকার সময় বিবেচনা করলে ভারতবাসী কারো পক্ষেই এই বিরোধিতা করার কোন কারনই নেই । তাছাড়া কোথাও সেই ধরনের মটিভেশনে আল মাহমুদ কিছু করেছেন বলে নিজেও দাবী করেন নি , বরং বিভিন্ন জায়গায় কবি সাহিত্যিকদের সাথে ঘুরে বেড়ানোর অনেক বর্ণনা আছে । বলা বাহুল্য সেগুলো নিছকই কবি সাহিত্যিকদের চিরন্তন আড্ডাবাজী , সেখানে মুক্তিযুদ্ধের কোন বিষয়ই নেই ।

শামসুর রাহমান যখন অবরুদ্ধ দেশে থেকেও ছদ্মনামে স্বাধীনতার কবিতা লিখে স্বাধীন বাংলা বেতারে পাঠাচ্ছেন , অসংখ্য সাহিত্য সাংস্কৃতিক কর্মী যখন স্বাধীন বাংলা বেতারকে মুখর করে রেখেছেন , কবি আলমাহমুদ তখন স্বাধীন বাংলা বেতারে কী করছেন , দেখা যাক :

“এ সময় আমি মাঝে মধ্যে বালুহাককাক লেনের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অফিসে হাজিরা দিতে যেতাম । কিন্তু রেডিওতে অংশগহন করিনি । কারন আমার পরিবার-পরিজন তখনো বাংলাদেশে অনিশ্চিত অবস্থঅয় কাল কাটাচ্ছিল এবং পরিবার পরিজনের কোন খবরই আমার জানা ছিল না । ”

কবি আল মাহমুদের সাহস বোঝা যায় এখানে ।

কবি কি তখন কিছু লিখছেন না ? লিখছেন ।
তিনি জানাচ্ছেন , আনন্দবাজার রবিবাসরীয় বিভাগে তখন তিনি ”প্রকৃতি ” কবিতাটি লিখেছেন । প্রকৃতি কবিতাটি আমার পঠিত বলে স্মরণ আসছে না , তাই মন্তব্য করছি না , তবে কবিতার নাম দেখে সেটিকে যুদ্ধের সাথে সংশ্রব আছে , এমন কোন কবিতা বলে মনে হচ্ছে না ।

এসময় কবি কলকাতা থেকে তার কাব্যগ্রন্থ বের করার চেষ্টা করেন এবং সফল হোন । সেটি ” আল মাহমুদের কবিতা ” শিরোনামে অরুণা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় । সেখানে যুদ্ধের কোন কবিতা ছিল বলে কবি দাবী করেন নি ।

বরং তিনি এক বস্তিবাসী যুবতীর ঘরে নিরীহ রাত যাপন করেছেন বলেও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন , তাছাড়া পূর্বে উল্লেখিত রাজেশ্বরী রায় চৌধুরীর সাথে তার ঘনিষ্ট ঘুরাফেরা কানাঘুষার জন্ম দেয় বলেও ইঙিত পাই আমরা ।

কবি তখন নিজেকে নিয়েই মগন ছিলেন ।

“এ সময় আমার মানসিকতায় একটু শৈথিল্য দেখা দিয়েছিল ,কেমন যেন গা ছাড়া ভাব । আমি মনে প্রানে আল্লাহর কাছে যৌন সংযম প্রার্থনা করতাম ।”

কারন , কবির সনেটন নিয়ে একটি মিনিবুক প্রকাশিত হয়েছিল , সোনালি কাবিনের সেই কবিতাগুলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রী তাদের ব্লাউজের ভেতর রাখত বলে কবি খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন ।

কবির এই ঘুরাফেরা যে অনেকেরই পছন্দ হয় নি , সেটা বুঝা যায় যখন কবি আরো জানান :

” এর মধ্য একদিন হঠাৎ একটি পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে একটি প্রবন্ধ ছাপা হলো । তারা লিখেছেন , আমি নাকি ভিআইপিদের মতো পোশাক পরে কফি হাউসে ঘুরে বেড়াই ।”

কবি অবশ্য এগুলোকে নকশালপন্থী লেখকদের ষড়যন্ত্র বলে দাবী করেছেন তার বইয়ে ।

শেষ কথা :

কবির আত্মজীবনী পড়ার পরে আর অন্যান্য বইয়ের রেফারেন্স টানার দরকার মনে করছি না ।
৭১ সালে কবি কী করেছেন , কী করেন নি , সেটা উনার ব্যক্তিগত ব্যাপার ।

কিন্তু সার্বিক বিচার করে মনে হচ্ছে কবি আল মাহমুদ আসলে প্রভাবশালী ভগ্নীপতির ছত্রছায়ায় কলকাতার জীবনে খুবই আরামে ছিলেন । ভগ্নিপতি তাকে একটি আইডি কার্ড ধরিয়ে দিয়েছিলেন , মুক্তিযুদ্ধের সাথে এটাই কবির প্রত্যক্ষ যোগাযোগের বড় পরিচয় ।
দেখা যাচ্ছে , আত্মীয় স্বজন মামা চাচার জোরের বিষয়টা বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার সাথে একই সময়েই জন্ম নিয়েছিল ।

কবি আল মাহমুদকে যদি মুক্তিযোদ্ধা কবি বলা হয় , তাহলে জামাতিদের ” মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ”কেও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন হিসেবে মেনে নিতে হবে , এটাই আমার মনে হচ্ছে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *